ব্রেকিং নিউজ

6/recent/ticker-posts

মানুষে মানুষে আত্মিক বন্ধন তৈরি হয় রাখির বন্ধনীতে

 


হিমাদ্রিশেখর মণ্ডল  :  বলতে গেলে শুধু এক টুকরো সুতোর বাঁধন। কিন্তু তাতেও বাঁধা পড়ে যায় সম্পর্ক। সেই সুতোটুকু ধরেই পুরুষ ও নারীর মধ্যে একটা প্রীতির আত্মীয়তা গড়ে ওঠে। দেশ, কাল, জাতির কোনও সীমারেখা না মেনেই মানুষে মানুষে আত্মিক বন্ধন তৈরি হয় রাখির বন্ধনীতে।

  ইতিহাসও সেই রকম কথা বলে। বহুদিন আগের কথা। চিতোর আক্রমণ করতে আসেন মুসলিম বাদশা বাহাদুর শাহ। চিতোরকে রক্ষা করতে রানি কর্ণাবতী নবাব হুমায়ুনের কাছে রাখি পাঠালেন। সঙ্গে চিতোরকে রক্ষা করার আর্জি জানিয়ে একটি পত্র। নবাব হুমায়ুন সেই রাখি পেয়েই রানি কর্ণাবতীর সঙ্গে ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যান। তৎক্ষণাৎ তিনি সৈন্য-সামন্ত নিয়ে দিল্লি থেকে চিতোরে রওনা হন বিধবা রানি কর্ণাবতীকে রক্ষা করতে। অবশ্য তিনি চিতোরে আসার আগেই রানি কর্ণাবতী জহর ব্রতে প্রাণ বিসর্জন দেন। তবু এই ঘটনা প্রমাণ করে এক হিন্দু রমণীর পাঠানো রাখির সূত্রে কেমন করে সৌহার্দ্যের বন্ধনে জড়িয়ে পড়েন এক মুসলিম নবাব।

 এমন গল্প আরও আছে পুরাণে, মহাভারতে। বৃত্রাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন দেবরাজ ইন্দ্র। দেবগুরু বৃহস্পতির নির্দেশে ইন্দ্রপত্নী শচী, ইন্দ্রের হাতে বেঁধে দিলেন একগাছি সুতো। অসুরের সঙ্গে যুদ্ধে দেবরাজ যাতে নিজেকে রক্ষা করতে পারে সেই কামনা করে। ইন্দ্রের হাতের সেই সুতো হয়ে গেল নিরাপত্তার বন্ধন। 'রক্ষাবন্ধন'।

  মহাভারতেও রয়েছে রাখি বন্ধনের এমন প্রতীকী গল্প। রাজসূ্য় যজ্ঞের আগে শিশুপাল বধের পর শ্রীকৃষ্ণের হাত কেটে রক্তপাত হয়। পাঞ্চালি তখন নিজের আঁচল থেকে খানিকটা অংশ কেটে কৃষ্ণের হাতে বেঁধে দেন রক্তপাত বন্ধ করতে। শ্রীকৃষ্ণ সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করেন যে, তিনি পাঞ্চালির সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। পাঞ্চালির নিরাপত্তার দায়িত্ব তখন থেকেই হয়ে যায় শ্রীকৃষ্ণের। আর তাই কৌরবসভায় বস্ত্রহরণ কালে দৌপদী কৃষ্ণকে স্মরণ করলে শ্রীকৃষ্ণ অন্তহীন বস্ত্র হয়ে লজ্জা নিবারণ করেন অসহায় ভগ্নির। 

 ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় জাতীয় ঐক্য বজায় রাখতে হিন্দু-মুসলিম পরস্পর পরস্পরের হাতে রাখি বেঁধে দেন। এই উৎসবে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রাখি উৎসবকে কেন্দ্র করে তিনি গান লিখেছিলেন--- "বাংলার মাটি বাংলার জল...."

  রাখি বন্ধনের নেপথ্যে এমন অনেক গল্প ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পুরাণ, ইতিহাস জুড়ে। রাখি বন্ধন আসলে সর্বজনীন উৎসব। যে উৎসবের মূল রীতিটা সুতোর বন্ধনে সম্পর্কের নিগূড়ে বন্দি হওয়া। তাই প্রতিবছর অগস্ট মাসের পূর্ণিমার দিনটিতে এই উৎসব চলে। তবে ভিন্ন ভিন্ন নামে।

  ইদানিং সুন্দরবন অঞ্চলেও এই রাখি বন্ধনের বেশ চল হয়েছে। এই উপলক্ষে নানা জায়গায় নানা অনুষ্ঠান হচ্ছে। প্রত্যন্ত সুন্দরবন অঞ্চলের সন্দেশখালি-২ ব্লকের মণিপুরে রায়মঙ্গল নদীর চরে (বোয়ালিয়ার চর) বেশ বড় অনুষ্ঠান হয়। রাখি বন্ধন উপলক্ষে এদিন কয়েক হাজার মানুষ একত্রে মিলিত হন। ভাটার সময় রায়মঙ্গল নদীর চর জেগে উঠলে রায়মঙ্গল নদীর মাঝখানে সেই চরে গিয়ে সবাই রাখি পরায়। রায়মঙ্গল নদীতে জোয়ারের জল এলে আবার সবাই ফিরে আসে।  কয়েক ঘণ্টার জন্য উৎসবে মেতে ওঠে কয়েক হাজার মানুষ।

  সন্দেশখালির কাঠখালি কোচিং সেন্টারের উদ্যোগেও রাখি বন্ধন উৎসব পালিত হয়। এই উপলক্ষে ৮ দলের ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় প্রতিবছর রাখি পূর্ণিমার দিন। এদিন সকল ফুটবল প্লেয়ারদের হাতে রাখি পরিয়ে ভাতৃত্বের বন্ধনে সকলকে আবদ্ধ করা হয়। সন্দেশখালি দুর্গামণ্ডপে হিমাদ্রি মিশনের উদ্যোগে রাখি বন্ধন উৎসব পালিত হয়। গোসবা ব্লকে রাখি পূর্ণিমার দিন গোসাবা উত্তর সার্কেলের প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে প্রতিবছর আট দলের ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হয়।

 এখন রাজ্য যুব দফতরের উদ্যোগেও রাজ্যের প্রতি ব্লকে রাখি বন্ধন উৎসব পালিত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোও এখন ঘটা করে রাখি বন্ধন উৎসব পালন করছে।

 সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামে সিরাজের চায়ের দোকানে দেখা গেল রাম- রহিম একত্রে বসে চা খাচ্ছে। চা খাওয়ার পর রহিম একটা বিড়ি ধরিয়েছে। দু'টান দেওয়ার পরই রাম বলে ওঠে, একাই সব খাবি আমাকে অন্তত দুটো টান দে। রহিম তাকে নির্দ্বিধায় দিয়ে দেয়। দু'জনে মিলে একটা বিড়ি আয়েশ করে খায়। এই বর্ষার সময় সুন্দরবন অঞ্চলে গেলে দেখা যাবে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে মাঠে কাজ করছে। তারা বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে একটা আলের ওপর বসে শরীরটাকে একটু গরম করার জন্য একটা বিড়ি দু'জনে মিলে টান দিচ্ছে। এরা কিন্তু 'সম্প্রীতি' শব্দের মানে বোঝে না। সম্প্রীতি জিনিসটা কী? খায়, নাকি মাথায় দেয় তাও জানে না। ওরা জানে না সম্প্রীতি বুকের ভেতর কোথায় লুকিয়ে থাকে। ওরা শুধু জানে, জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য একে-অপরের পাশে থাকতে হয়। অথচ অত্যন্ত দুঃখের বিষয় সম্প্রীতির পাঠ শেখাতে হয় শহুরে শিক্ষিত সমাজকে। কোথাও কোনও অঘটন ঘটলেই রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনগুলি সম্প্রীতি রক্ষার জন্য পদযাত্রা বা মোমবাতি মিছিল প্রতিযোগিতা শুরু করে দেয়। সম্প্রীতি রক্ষার জন্য পদযাত্রা মোমবাতি মিছিল করলে মিডিয়ায় প্রচার পাওয়া যায়, কিন্তু তাতে সম্প্রীতি রক্ষা করা যায় না। নিজের পরিবার ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশই সম্প্রীতির পীঠস্থান। বাইরে থেকে চাপিয়ে দিলেই সম্প্রীতি রক্ষা করা যায় না। আর তাই শিশুমনে সম্প্রীতির বীজ রোপণ করতে হয়। আর সেই চারা বেড়ে ওঠার জন্য বিশুদ্ধ পরিবেশের প্রয়োজন হয়।

       আসুন, রাখি বন্ধন উৎসব- এর মাধ্যমে সম্প্রীতি ও সংহতির সেতুবন্ধনে আমরা সকলে মিলে উদযাপন করি 'সংস্কৃতি দিবস'। দেশের বর্তমান এই অস্থিরতার সময়ে এই ধরনের অনুষ্ঠান যত হবে দেশ ও জাতির পক্ষে ততই মঙ্গল।

Post a Comment

0 Comments