ব্রেকিং নিউজ

6/recent/ticker-posts

মানুষের ভালোবাসা ও সহানুভূতির আশায় হাসিপাহারির কুষ্ঠ রোগীরা

 জীবন-জীবিকার জন্য ঝাড়খন্ড সরকারের কাছে বিশেষ যোজনার আবেদন তাদের

বিশ্বরূপ দে  :  "একটু সহানুভূতি মানুষ কি পেতে পারে না, ও বন্ধু - মানুষ মানুষেরই জন্যে. . . . ."।

  পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোল সাব-ডিভিশন অন্তর্ভুক্ত চিত্তরঞ্জন ও ঝাড়খন্ড সীমানার কাঙ্গুই পাহাড় সংলগ্ন হাসিপাহারি অঞ্চলে এসে ভূপেন হাজারিকার গানের উপরিউক্ত পংতিটিই মনে পড়ে গেল ।

  গ্রামটির নাম সেনপুর-হাসিপাহারি । ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে গ্রামটি ঝাড়খন্ড রাজ্য অন্তর্ভুক্ত জামতারা জেলার অধীন । ছোট্ট পরিসরের এই গ্রামটিতে হাতে গোনা এমন কিছু মানুষের বসবাস, যাদের জীবিকা কেবলই ভিক্ষাবৃত্তি । ভাবতে অবাক লাগে, যে দেশে দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারি মানুষের আর্থিক অবস্থা উন্নতির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রকল্প ও যোজনা চালু করা হয়েছে, সেদেশেরই কোন এক রাজ্যের সামান্য কিছু মানুষ আজও তাদের জীবন-জীবিকা বা রুজি-রুটির তাগিদে ভিক্ষাবৃত্তির ওপর নির্ভরশীল । দুর্ভাগ্যের বিষয়, আর পাঁচটা মানুষের মতো শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জনের সদিচ্ছা ও মানসিকতা থাকা সত্বেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে বাধ্য হয়েই তারা আজ মানুষের দয়া-দাক্ষিণ্য বা ভিক্ষাবৃত্তির ওপর নির্ভরশীল । কারা ওরা ?

-- ওরা ঝাড়খণ্ডের জামতারা জেলা অন্তর্ভুক্ত সেনপুর-হাসিপাহারির কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত একদল "মানুষ"। দীর্ঘ প্রায় ২৫/৩০ বছর ধরে পরিবার পরিজনদের নিয়েই এই গ্রামে তাদের বসবাস ।

  কাঙ্গুই পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে গ্রামের পথে পা বাড়িয়েই চোখে পড়লো ছোট ছোট মাটির ঘর বেষ্টিত একচিলতে বস্তি । আর এখানেই বসবাস তথাকথিত "সভ্য ও সামাজিক" মানুষের ঘৃণা আর অবহেলার শিকার হয়ে পড়ে থাকা এমন কিছু মানুষের, যারা কুষ্ঠ নামক জরা ও ব্যাধিতে আক্রান্ত । কিন্তু এদের চাইতেও আরো ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত সেইসব মানুষ, যারা তাদের প্রতি সহৃদয় বা সহানুভূতিশীল হওয়ার পরিবর্তে ওদের সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, অবহেলা করে, ঘৃণা করে । তবুও সমাজের এই স্বার্থপর মানুষগুলোর বিরুদ্ধে এতটুকু ক্ষোভ বা বিদ্বেষ নেই ওদের । নেই তেমন কোন বড় চাহিদা । চাই সামান্য একটু ভালোবাসা, সহানুভূতি আর দুবেলা দুমুঠো গরম ভাত এবং চিকিৎসা -- এমনটাই বললেন সেনপুর হাসিপাহারি গ্রামের কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত প্রবীণ নাগরিক দিলীপ সোরেন । 


  সাক্ষাৎকারে তিনি বললেন,"খেটে খাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও ব্যাধিগ্রস্ত অসার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কারণেই বাধ্য হয়ে মানুষের কাছে ভিক্ষার জন্য হাত পাততে হয় । কিন্তু বহু মানুষ আমাদের জরাগ্রস্ত হাত-পা দেখে ঘৃনায় দূরে সরে যায় । এমনকি অনেক সময় দূর দূর করে তাড়িয়েও দেয়"। 

  ঝাড়খন্ড সরকারের রেশন ব্যবস্থা অনুসারে সকলের জন্য মাথাপিছু  ৫ কিলো করে খাদ্যশস্য ও "ডালভাত" যোজনা অনুসারে ৫ টাকার বিনিময়ে দিনে একবার দরিদ্র মানুষের জন্য খাদ্য সরবরাহের বন্দোবস্ত থাকলেও, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা এবং চরম আর্থিক অনটনের জন্য রেশন বা "ডালভাত" যোজনা থেকেও মাঝেমধ্যে বঞ্চিত হতে হয় ওদের । তবুও চরম প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে সন্তানদের দূর-দূরান্তের কোন আশ্রম বা অবৈতনিক হোস্টেলে পাঠিয়ে দিয়ে এদিক ওদিক থেকে ভিক্ষা করেই কোনমতে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেন এই গ্রামের ২৫ থেকে ৩০টি পরিবারের প্রায় ১০০ জন মানুষ । 

  জামতারা জেলা হাসপাতালের পক্ষ থেকে চিকিৎসা বাবদ কিছু গজকাপড় আর ওষুধ দেওয়া হয়, তা দিয়ে নিজেরাই ক্ষতস্থান বেঁধে রাখেন । কিন্তু তাতে তেমন কোন ভালো ফল পাওয়া যায় না । ক্রমশই সংক্রমিত হতে থাকে ক্ষতস্থান এবং একসময়ে পঙ্গুত্ব ও অঙ্গহানি । কিন্তু বাবা-মায়ের থেকে এই রোগ তাদের সন্তান-সন্ততির মধ্যে সংক্রমিত হচ্ছে না বলেই জানালেন দিলীপ সোরেন । মাঝেমধ্যেই বহু মানুষ এই অঞ্চলে বেড়াতে আসেন, তবে তাদের দিক থেকে কোন সাহায্য বা সহানুভূতি পাওয়া যায় না । খোঁজও নেয় না কোন সমাজসেবী সংস্থা । আর তাই কাতর কন্ঠে দিলীপ সোরেন ও গ্রামের অন্যান্যদের আবেদন যে "সরকারের পক্ষ থেকে যদি আমাদের জীবন-জীবিকার জন্য বিশেষ কোন যোজনার বন্দোবস্ত করা হয় তাহলে উপকৃত হবো"।

Post a Comment

0 Comments