ধামসা-মাদলের তালে কোমর দুলিয়ে নয়, দারিদ্র দূর করতেই মহুল রসের কারবার
বিশ্বরূপ দে : বাংলার আদিবাসী অধ্যুষিত বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে আজও প্রচলন আছে হাড়িয়া ও মহুয়া রসের মতো মাদক দ্রব্য পান করার রীতি । মূলত সাঁওতাল পরগণার মানুষেরাই বিভিন্ন উৎসব পার্বনে এ জাতীয় মাদক সেবন ও ধামসা-মাদলের তালে নাচ-গানের মধ্যে দিয়ে তাদের আনন্দ উপভোগ করে থাকে । এই প্রথা সাঁওতালদের চিরাচরিত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত । যদিও হাড়িয়া বা মহুয়া রস পান করা এখন আর শুধুমাত্র আদিবাসী বা সাঁওতালদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় । বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়ায় বেড়াতে আসা দেশ-বিদেশের বহু পর্যটকও হাড়িয়া বা মহুয়া রস (মহুল রস) পান করার তাগিদে ছুটে যায় বাংলার আদিবাসী বা সাঁওতাল অধ্যুষিত গ্রামীণ অঞ্চলে ।
পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল সাব-ডিভিশন অন্তর্গত চিত্তরঞ্জন সীমান্তবর্তী নামোকেশিয়া পঞ্চায়েতে এসে জানা গেল, দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারি এই অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত বেশ কিছু মানুষ আজও মহুয়ার রস থেকে তৈরি মাদক পানীয় প্রস্তুত ও বিক্রির মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে ।
অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষই সরকারি বা বেসরকারি ক্ষেত্রের বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত, কিন্তু পারিবারিক দারিদ্রের কারণবশত শিক্ষাগত যোগ্যতার অভাবে, বাধ্য হয়েই অঞ্চলের বেশ কিছু মানুষ মহুয়া বা মহুল রসের কারবারের মাধ্যমে নিজেদের রুজিরুটির বন্দোবস্ত করে চলেছে । এক কথায় বলতে গেলে জীবনের আনন্দ উপভোগ করতে ধামসা-মাদলের তালে কোমর দুলিয়ে নয়, বরং দারিদ্র দূরীকরণে মহুল রসের কারবারে নিযুক্ত এই অঞ্চলের হাতে গোনা কয়েকটি আদিবাসী পরিবার ।
আসানসোলের বেশ কয়েকটি গ্রামের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের মানুষই এই পেশায় নিযুক্ত । তার মধ্যে অন্যতম হলো চিত্তরঞ্জন সীমান্তবর্তী নামোকেশিয়া পঞ্চায়েত । এখানকার বেশ কয়েকটি পরিবার এই কারবারের মাধ্যমেই নিজেদের জীবন জীবিকা অতিবাহিত করে ।
কিন্তু কি এই মহুল রস ? আর কীভাবেই বা প্রস্তুত করা হয় ? --
নামোকেশিয়া পঞ্চায়েতের এক মহুল রস প্রস্তুত কারক আদিবাসী যুবক নিজের নাম গোপন রাখার শর্তসাপেক্ষে জানায়,"পার্শ্ববর্তী এলাকায় বেশ কিছু মহুল বা মহুয়া গাছ থাকলেও মূলত বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ইত্যাদি জায়গা থেকে কাঁচা মহুয়া ফল সংগ্রহ করা হয় । তারপর সেগুলোকে বস্তাবন্দি অবস্থায় বেশ কিছুদিন রেখে দেওয়ার পর, উন্নত মানের ভেলি গুড় ও বাকর নামক একপ্রকার বস্তু সহযোগে প্রায় দিন সাতেক পরিমাণ মতো জলে ভিজিয়ে রাখা হয় । মহুয়া, গুড় ও বাকর মিশ্রিত জল গেজিয়ে উঠলে মাটির উনুনে অগ্নিসংযোগে জাল দিয়ে যে বাষ্প উৎপন্ন হয়, সেই বাষ্প থেকেই নির্গত জল বা রসই মহুয়া বা মহুল রস । তবে মিশ্রনে বাকরের পরিমান মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেলে মহুল রস পান করে বিষক্রিয়ায় মানুষের শারীরিক ক্ষতিও হতে পারে । খেতে মিষ্টি ও সুস্বাদু হলেও হাড়িয়ার চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী মাদক পানীয় এই মহুয়া বা মহুল রস"।
সম্প্রতি পুলিশ প্রশাসনের তৎপরতায় অঞ্চলে মহুল রস প্রস্তুত ও বিক্রির ক্ষেত্রে কড়া নজরদারি ও নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার দরুন অনেকটাই ভাটা পড়েছে ব্যবসায় । তবুও রুজিরুটির তাগিদে দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারি কিছু আদিবাসী মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আজও মহুল রস প্রস্তুত ও বিক্রির মাধ্যমে নিজেদের জীবন সংগ্রামের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করে । যার মূল্য - দৈনিক গড়ে ৪০ থেকে ৬০ টাকা মাত্র ।
0 Comments