অরণ্য সন্নিহিত আদিবাসীদের পাশে বন বিভাগের আধিকারিকরা
বিশ্বরূপ দে : অরণ্য ও অরণ্য সন্নিহিত অঞ্চলের মানুষকে সুরক্ষিত রাখতে এক অভিনব ও প্রসংশনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন রাজ্যের বন বিভাগের সিসিএফ (চিফ কনজার্ভেটর অফ ফরেস্ট) কুনাল ডাইভাল ।
বন ও বন্যপ্রাণ রক্ষায় সরকার ও বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে বিগত দিনে অজস্র সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে । কিন্তু একশ্রেণীর মানুষের অসাধু মনোভাবে আজ বিপন্ন বন্যপ্রাণ । নিজের স্বার্থে মানুষই অবাধে ধ্বংস করে চলেছে প্রকৃতি ও তার বহুমূল্যবান সম্পদ - বন্যপ্রাণ । বন্যপ্রাণ রক্ষা ও সংরক্ষণের আইনকে একপ্রকার বুড়ো আঙুল দেখিয়েই দিনেরাতে অবাধে লুঠ হয় অরণ্য । গাছ কাটা থেকে শুরু করে, বন্যপ্রাণী হত্যার মতো ঘটনাও সামনে এসেছে বহুবার । এসবের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে সরকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে জঙ্গল সংলগ্ন এলাকায় সচেতনতামূলক কর্মসূচি, সেমিনার ও আইনি বন্দোবস্ত করেও একশ্রেণীর মানুষের দ্বারা অরণ্য-লুঠ ঠেকানো সম্ভব হয়নি । ফলে, ক্রমশ ধ্বংসের মুখে বন্যপ্রাণ । তবুও অরণ্য সুরক্ষায় সর্বদা রক্ষণশীল ও তৎপর বন বিভাগ ।
বন ও বন্যপ্রাণ রক্ষায় জঙ্গল সংলগ্ন মানুষ বা আদিবাসীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য । শুধুমাত্র আইন বা পুলিশ-প্রশাসন দিয়েই যে জঙ্গল রক্ষা করা সম্ভব নয়, তা প্রমাণিত হয়েছে বহুবার । জঙ্গলকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র জঙ্গল সংলগ্ন এলাকার মানুষ বা আদিবাসীরাই । কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে তাদের দ্বারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় জঙ্গল । এর অন্যতম কারণ হলো চরম আর্থিক সঙ্কট ।
এই আর্থিক সঙ্কটের দরুন তারা বঞ্চিত হয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খাদ্যের ন্যূনতম অধিকার থেকে । কারণ আমাদের সমাজব্যবস্থায় মানুষের ন্যূনতম অধিকারটুকুও অর্জন করতে হলে অর্থের প্রয়োজন । আর সেই অর্থ সঙ্কটের কারণেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে জঙ্গল নির্ভর হতে হয় তৎসংলগ্ন অঞ্চলের দরিদ্র মানুষ বা আদিবাসীদের । বন বিভাগের নজর এড়িয়ে জঙ্গলের গাছ কাটা থেকে শুরু করে, জঙ্গলের শুকনো পাতা বা গাছের শুকনো ডালপালা কুড়োনোই যাদের জীবন জীবিকা, তাদের কাছে শিক্ষা-স্বাস্থ্যের খরচ জোটানো স্বপ্নাতীত । ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের পরিষেবা থেকে কার্যত বঞ্চিতই থেকে যায় জঙ্গল সংলগ্ন এলাকার আদিবাসী মানুষেরা । আর তাই এদের কাছে জঙ্গল বা অরণ্য রক্ষা ও সংরক্ষণের "ভাষণ" অরণ্যে রোদনের সমান । কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সমগ্র বনাঞ্চল এবং অচিরেই পতন ঘটবে মানবসভ্যতার । কারণ বন্যপ্রাণ সুরক্ষিত না থাকলে অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে পড়বে মানবজাতি । আর তাই ঠিক বিপরীতে মানব কল্যাণে বন্যপ্রাণ রক্ষা ও সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি । আর বন্যপ্রাণ রক্ষা করতে পারে একমাত্র জঙ্গল সংলগ্ন এলাকার মানুষ বা আদিবাসীরা । মূলত এই ভাবনা থেকেই অরণ্য সন্নিহিত মানুষের উদ্দেশ্যে সুরক্ষা ও সহায়তা প্রদান কর্মসূচির প্রসংশনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন রাজ্যের বন বিভাগের সিসিএফ কুনাল ডাইভাল - এমনটাই জানালেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা "অর্চি"-র কর্ণধার প্রলয়েশ লাহিড়ী ।
ইতিমধ্যেই পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও বীরভূমের বিভিন্ন রেঞ্জ অন্তর্ভুক্ত বন বিভাগের বিট অফিসে বন বিভাগ ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা "অর্চি"-র যৌথ উদ্যোগে শুরু করা হয়েছে বিনামূল্যের মাসিক স্বাস্থ্য শিবির ।
প্রতিমাসের নির্ধারিত দিনে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর রেঞ্জের চৌগান বিট ও হিরবাঁধ বনাঞ্চল এবং বীরভূমের রাজনগর রেঞ্জ অন্তর্ভুক্ত চন্দ্রপুর বিট অফিসের স্বাস্থ্য শিবিরে এসে বিনামূল্যের চিকিৎসা পরিষেবা গ্রহণ করেন অসংখ্য মানুষ । এদের অধিকাংশই দরিদ্র আদিবাসী । এই স্বাস্থ্য শিবিরগুলিকে সচল রাখতে এবং আরো প্রসারিত করতে সিসিএফ কুনাল ডাইভালের পাশাপাশি আন্তরিকভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বাঁকুড়ার ডিএফও (ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার) সত্যজিৎ রায়, বিষ্ণুপুরের রেঞ্জ অফিসার তপোব্রত রায়, চৌগান বিট অফিসার বিমান চন্দ্র রায় সহ বন বিভাগের অন্যান্য আধিকারিকরা ।
এক সাক্ষাৎকারে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর রেঞ্জ অন্তর্ভুক্ত চৌগান বিট অফিসার বিমান চন্দ্র রায় বলেন,"এই স্বাস্থ্য শিবিরের মাধ্যমে বহু মানুষ উপকৃত হচ্ছেন । প্রত্যেক মাসের নির্দিষ্ট দিনে প্রায় হাজারো মানুষ এই শিবিরে এসে স্বাস্থ্য পরিষেবা গ্রহণ করেন । বিশিষ্ট চিকিৎসকের পরামর্শ ও ওষুধে বহু দিনের দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তিলাভ করে অনেক মানুষ সম্পূর্ন সুস্থ হয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি"। শিশু থেকে প্রবীণ - প্রত্যেকেরই চিকিৎসা করা হয় এই স্বাস্থ্য শিবিরে । ফলে যথেষ্ট উপকৃত হয়েছেন স্থানীয়রা ।
এর পাশাপাশি, পুরুলিয়ার ঝালদা রেঞ্জ অন্তর্ভুক্ত খামার বিটেও ২০১৭ সাল থেকে স্বাস্থ্য শিবিরের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের চক্ষু পরীক্ষা, চশমা প্রদান, কম্বল বিতরণ সহ নানারকম পরিষেবা দেওয়া হতো । সম্প্রতি এই অঞ্চলের বন-আধিকারিক দ্বারা সৃষ্টি হওয়া জটিলতার কারণে তা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রলয়েশ লাহিড়ী । তবে পুনরায় তা শুরু করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি । চলতি মাসের শুরুতে বীরভূম জেলার সিউড়ির দুবরাজপুর পঞ্চায়েত অন্তর্গত মেটেগাঁয় এডিএফও দেবরাজ সুর, রেঞ্জ অফিসার কুদরতে খোদা, বিট অফিসার বিক্রম পাখরিন, ফরেস্ট গার্ড নূর আফসার আলী ও অন্যান্য বনকর্মীদের সহযোগিতায় দুস্থ ও অসহায় শতাধিক আদিবাসী মানুষকে কম্বল ও শিশুদের জন্য খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করে "অর্চি"। এই সহায়তায় স্বাভাবিকভাবেই খুশি আদিবাসীরা ।
আগামীদিনে এই উদ্যোগ আরো প্রসারিত হবে বলেই আশাবাদী বন বিভাগের উল্লিখিত আধিকারিকরা ও অর্চি ।
0 Comments