ভালোবাসা দিয়ে মানুষ ও বন্যপ্রাণের মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছিলেন স্টিভ ইরুইন
বিশ্বরূপ দে : ১৯৬২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন স্টিভ ইরুইন । মাত্র ছ'বছর বয়সে বাবা বব ইরুইনের অনুপ্রেরণায় নিজে হাতে একটি বিষধর সাপকে উদ্ধার করে সাহসিকতার পরিচয় দেয় এবং সেই থেকেই তাঁর সরীসৃপ সহ অন্যান্য প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয় ।
এই ভালোবাসা থেকেই বড় হয়ে তিনি অস্ট্রেলিয়ান জু-তে "জু-কিপার" হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন ।
সেখান থেকে ধীরে ধীরে wildlife conservationist হয়ে ওঠেন । তাঁর উদ্যোগেই টিভির পর্দায় প্রথম animal planet-এর বিশেষ আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান শুরু হয় । সেই প্রোগ্রামের জনপ্রিয়তা তাঁকে wildlife lover-এর শিখরে পৌঁছে দেয় ।
Reptiles অর্থাৎ সরীসৃপ গোত্রীয় প্রাণীদের মধ্যে অধিকাংশ সময় কুমির নিয়েই সারাক্ষণ থাকতেন বলে তাঁর নাম হয়ে ওঠে "crocodile man" । কুমির, সাপ ইত্যাদি সরীসৃপ প্রাণীদের তিনি কখনো তাঁর থেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন না । পরম স্নেহ আর মায়া মমতায় তাদের সাথে সন্তানসম সম্পর্ক স্থাপন করে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ wildlife lover-এর খ্যাতি অর্জন করেছিলেন । বন্যপ্রাণীদের ভালোবাসা ও রক্ষনাবেক্ষনের পাশাপাশি তিনি বন ও বন্যপ্রাণীদের প্রতি সমগ্র বিশ্ববাসীকে রক্ষণশীল ও সহৃদয় হতে সচেতনতামূলক বার্তা ও অনুষ্ঠানের বন্দোবস্ত করতেন । তাঁর এই কাজে সর্বক্ষণের সাথী ছিলেন স্ত্রী টেরি ইরুইন । পরবর্তীতে দুই ছেলেমেয়ে বিন্দি ও রবার্টও বাবা-মায়ের সাথে কুমির, অজগর, বিভিন্ন বিষধর সাপের মতো সরীসৃপ ও অন্যান্য প্রাণীদের যত্ন-পরিচর্যা করতেন ।
সমুদ্রের তলদেশে কুমিরদের সাথে দীর্ঘক্ষণ বসবাস করতেন স্টিভ, তাদের সাথে খেলা করতেন এই মানুষটি । নিজেকে এমনভাবেই বন্যপ্রাণীদের সাথে একাত্ম করে নিয়েছিলেন স্টিভ । তাঁর বিশ্বময় খ্যাতিতে অনেকেই হিংসা ও ঈর্ষা প্রকট করতে শুরু করেছিলেন । কারণ তখন animal planet বা national geography-র মূল আকর্ষণীয় ও হাই টিআরপি-র প্রোগ্রাম ছিল সমুদ্রের তলদেশে স্টিভের "crocodile show" ।
আর তা থেকেই গভীর এক ষড়যন্ত্রের শিকার হন স্টিভ ।
২০০৬ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর সমুদ্রের তলদেশে এমনই এক শুটিং চলাকালীন সার্কের আক্রমণে মৃত্যু হয় মাত্র ৪৪ বছর বয়সী স্টিভ ইরুইনের - সেই সময়ে এমনটাই প্রকাশিত হয়েছিল খবরে । কিন্তু ঘটনার সত্যতা নিয়ে আজ পর্যন্ত কোন তথ্য সামনে আসেনি । এমনকি তাঁর স্ত্রী টেরি ইরুইনের পক্ষ থেকেও মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানার চেষ্টা করা হয়েছিল । কিন্তু সব তথ্য-প্রমানই হয়তো সমুদ্রের তলদেশে রয়ে গেছে ।
তাঁর মৃত্যুতে অনেকের সন্দেহ বা ধারণা, গভীর এক ষড়যন্ত্রের শিকার হন এই "great wildlife lover" স্টিভ ইরুইন । কিন্তু এটা বাস্তব যে মৃত্যু হয় কোন ব্যক্তির, অথচ তাঁর কীর্তি চিরকাল অমর হয়ে থাকে । আর স্টিভের সেই কীর্তির বর্তমান ধারক ও বাহক তাঁর স্ত্রী টেরি ইরুইন, পুত্র রবার্ট ও কন্যা বিন্দি ইরুইন ।
বন্যপ্রাণ ও মানুষের মধ্যে ঐতিহাসিক মেলবন্ধন ঘটিয়ে এক নতুন বিশ্ব সৃষ্টির স্বপ্ন দেখেছিলেন স্টিভ । কিন্তু একশ্রেণীর মানুষ, যারা বন্যপ্রাণ রক্ষা ও সংরক্ষণের বড় বড় ভাষণ মেরে আসলে তাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করতে চায়, স্টিভের মতো মানুষ তাদের পথের কাঁটা । সেই কাঁটা সাফ না করলে বাণিজ্য সফল হবে না - তাই গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চিরবিদায় নিতে হয় স্টিভের মতো মানুষদের । স্টিভের মৃত্যু রহস্যময় হলেও, সেই ঘটনা এক তাৎপর্যপূর্ণ শিক্ষা বা পাঠ আমাদের এই তথাকথিত "সভ্য" সমাজের মানুষদের উদ্দেশ্যে ভালোই দিয়ে গেছে যে বন্যপ্রাণীদের আগে অনেকসময় "হিংস্র" বা "নরখাদক" শব্দটি ব্যবহার করা হয়, কিন্তু এই কুৎসিত শব্দদুটি "মানুষ" নামক প্রাণীর আগে ব্যাবহার করাই উত্তম ।
0 Comments