ব্রেকিং নিউজ

6/recent/ticker-posts

আজ সাধক-বাউল ভবা পাগলার প্রয়াণ দিবস

 ১৯৫০ সালে দেশভাগের পর মা কালীর মূর্তি সঙ্গে নিয়ে ঢাকার বাড়ি ছাড়েন ভবা পাগলা

বিশ্বরূপ দে-র বিশেষ প্রতিবেদন

      কালীসাধক তথা প্রখ্যাত বাউল গান রচয়িতা ভবা পাগলার আসল নাম ভবেন্দ্র মোহন সাহা । ভবা পাগলার জন্ম ১৯০০ সালের ১৭ই অক্টোবর, বাংলার ১৩০৭ সালের ৩১শে আশ্বিন শুক্রবার, কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমা তিথিতে ঢাকা জেলার ধামরাই থানার আমতা গ্রামে । বাবার নাম গজেন্দ্র মোহন রায় চৌধুরী, মাতার নাম গয়াসুন্দরী দেবী । ভবারা তিন ভাই এক বোন । গিরীন্দ্র, দেবেন্দ্র, ভবেন্দ্র (ভবা) আর সতী আগমনী । দেবেন্দ্র আর ভবা জমজ ছিলেন । ভবা ত্রিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন দশ বছর বয়সী শৈবালিনীকে । ভবার সংসারে দুই ছেলে ও এক মেয়ে- সনতকুমার, প্রতিমা আর সংকল্প । ভবা পাগলা অধিকাংশ সময় শুধু একটা লাল বস্ত্রই পরিধান করতেন । তবে মাঝে মধ্যে সখ করে নীল বস্ত্রও পড়তেন তিনি । শেষ বয়সে ভক্তরা জোর করে কিছু জামা কাপড় পরিয়েছে । আর সোনায় মোড়ানো একটা লাঠি রাখতেন সঙ্গে সবসময় । তাতে ভক্তরা নানান অলঙ্কার জুড়ে দিয়েছিলো, মন্দির মসজিদ সবেরই সহাবস্থান ছিলো সেখানে অর্থাৎ ভবার ঘরে । তিনি ঘুমোতেন মাটিতে অথবা তক্তপোষে, মাথায় দিতেন একটা পিতলের কাঁসর । 

  ছোটবেলা থেকেই ভবা পারিবারিকভাবে কালীসাধক । ধামরাইতে নিজ বাড়িতে কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । পরবর্তীতে বাংলাদেশ আর ভারত মিলে গোটা সাতেক কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ভবা । 

  মা কালীকে নিয়েই ছোটবেলা থেকে সবসময় মজে থাকতেন ভবা । আর এই ভাবেই মুখে মুখে একদিন গান বানিয়ে ফেলেন -- "এসো মা কালী, শুন মা বলি, আমার প্রাণের বেদনা ।

লাগে না ভালো কি যে করি, তুমি আমায় বল না"। শোনা যায় এই গানটি তিনি ৬/৭ বছর বয়সেই রচনা করে মা কালীকে গেয়ে শোনান । 

  ছোটবেলায় স্কুলে পড়তে পড়তেই গড়ে তোলেন গানের দল এবং নিয়মিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান করতে থাকেন । অনুষ্ঠানে ভবা বেহালা বাজাতেন । শোনা যায় তার বেহালার হাত খুব সুন্দর ছিলো । এই গানের দল থেকেই ভবা গানের জগতে ঢুকে পড়েন । ফলে লেখাপড়া শিকেয় ওঠে তাঁর । কালীপূজা আর গান নিয়েই কাটতে থাকে ভবার সারাবেলা । 

  এইভাবে কেবল গান আর ভক্তসংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকে । আর তারসঙ্গে বাড়তে থাকে পাগলামী ও খামখেয়ালী জীবনযাপন । যদিও ভবা কিন্তু সংসারে খুব একটা অমনোযোগী ছিলেন না । 

  ভবার জীবনে ছন্দপতনের ঘটনা ঘটে দেশভাগের পরে । সেই সময় ভবাকেও ভাবতে হয় দেশ ছাড়ার কথা । তাঁর প্রিয় আমতা গ্রাম, কালী মন্দির আর পিতৃগৃহ ছেড়ে তাকে চলে যেতে হয় । বাংলার ১৩৫৭ সালের (ইংরেজি ১৯৫০) আষাঢ় মাসে তিনি দেশান্তরী হতে পথে নামেন । এরও একমাস আগে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের ভক্তসঙ্গে পাঠিয়ে দেন কোলকাতায় । পাগল ভবা সঙ্গে নিলেন তাঁর গানের সঙ্গী, পূজার সঙ্গী আর কিছু নিকট ভক্তবৃন্দকে । আর সঙ্গে নিলেন কষ্ঠিপাথরের তৈরি মা কালীর প্রিয় মূর্তিখানি । তৎকালীন কোলকাতার শোভাবাজারে ভক্ত ফটিকের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন ভবা । তারপর আরেক ভক্ত বি.বি.রায় তাঁকে বর্ধমানের কালনায় নিয়ে যান, সেখানে ভবা সপরিবারে এবং ভক্তপরিবেষ্ঠিত হয়ে এক বছর থাকেন । ইতিমধ্যে বর্ধমানের কালনায় জমি কিনে ১৯৫১ সালে কালীমন্দির সহ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন তিনি ।

  সাধক ভবাপাগলা মায়ের পূজার্চনায় কোন মাধ্যম পছন্দ করতেন না অর্থাৎ তাঁর মাতৃমন্দিরে নিত্যপূজার জন্য  ব্রাহ্মণ পুরোহিতের প্রয়োজন অনুভব করতেন না । তাই তিনি মায়ের আরাধনা ও পূজা নিজেই করতেন ।

  ভবা পাগলার গান বাংলাদেশ ও ভারতে বিভিন্ন স্থানে পরিচিতি লাভ করে । তিনি মূলত শ্যামা সঙ্গীত, ভাব গান, গুরুতত্ত্বের গান, দেহতত্ত্বের গান, ও সৃষ্টিতত্ত্বের গান রচনা করেন এবং নিজেই সুরারোপ করেন । 

  তাঁর উল্লেখযোগ্য গানগুলির মধ্যে, "এমন মানব জনম আর পাবেনা . . .", "ওরে মানুষ, দেখবি যদি ভগবান,

ছেড়েদে তোর হিংসাবৃত্তি,

ঐতো বিঘ্ন অতি প্রধান"।

  ১৯৮৫ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারী মাতৃসাধক ভবাপাগলা নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন । আজও তাঁর আশ্রমে বহুদূর থেকে ভক্ত-শিষ্যরা তাঁর টানে ছুটে আসেন । 

  সাধক ভবা পাগলা যেমন মা সারদাদেবী সহ বহু মহাত্মাদের সান্নিধ্য লাভ করেন, ঠিক তেমনই তাঁর পবিত্র সান্নিধ্যে অগণিত মানুষের জীবন ধন্য হয় । ভক্তদের অন্তরে আজও তিনি প্রকটিত, বিরাজিত ও আধার অনুযায়ী প্রকাশিত ।

Post a Comment

0 Comments