ব্রেকিং নিউজ

6/recent/ticker-posts

"ছেড়ে দিও না বন্ধু, বাঁচার যুদ্ধ" - বব মার্লে

"সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের মন থেকে ঘৃণা ও বর্ণপ্রথা নির্মূল করা সম্ভব" - বব মার্লে

রাস্তাফারাই আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক "রেগে" শিল্পী বব মার্লের জীবনী অবলম্বনে বিশ্বরূপ দে-র বিশেষ প্রতিবেদন

  

      আফ্রিকান "রেগে" শিল্পীদের ঐতিহাসিক লড়াই ও নয়া ঔপনিবেশবাদ বিরোধী সংগ্রামের ইতিহাস জড়িত "রাস্তাফারাই" আন্দোলনের কিংবদন্তিতুল্য "রাস্তা"-দের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বব মার্লে । নয়া ঔপনিবেশবাদের যাঁতাকলে অবহেলিত তৃতীয় বিশ্বের মানুষের অধিকার নিয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহনকারি বিদ্রোহী মানুষের বুকের সাহস হয়ে যিনি এক সময় প্রতিবাদী গান গাইতেন, তাঁর নাম বব মার্লে । গানের মধ্যে দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে শোষিত ও অবহেলিত মানুষের অধিকার রক্ষায় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের গান কিভাবে তাদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদেরই রক্তে রাজপথ রাঙিয়ে তুলে শোষকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে । ৬ই ফেব্রুয়ারি ছিল বিশ্ববিখ্যাত প্রতিবাদী রকসঙ্গীত শিল্পী সেই দুঃসাহসী বব মার্লের জন্মদিন । 

  "রাস্তাফারি" শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিনি বাঁধা লম্বা জটাওয়ালা চুল আর সদা হাস্যমুখর বব মার্লের ছবি । '৭০-এর দশকে বিশ্ব ছিল "মার্লেময়"। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সেই তাঁকে পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিতে হয় । 

  বব মার্লেকে যেদিন হত্যার জন্য গুলি করা হয়, তার ঠিক দুদিন পরেই একটা কনসার্টে গান গাওয়ার কথা ছিলো ববের । বুকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বব মার্লের জীবন নিয়েই যখন একদিকে টানাটানি, তখন কনসার্টের আয়োজকরা সার্বিক দিক বিবেচনা করে কনসার্টটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু বাধ সাধে একরোখা বব মার্লে নিজেই । তিনি কনসার্ট বাতিল করতে নারাজ হন এবং শেষমেষ আয়োজকদের পক্ষে কোনভাবেই তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আটকানো সম্ভব হয়নি । দুদিন পর অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময়েই তিনি মঞ্চে উঠলেন এবং গুলির আঘাতে দুর্বল শরীরেও স্রেফ মনের জোরে গেয়ে গেলেন তার প্রতিবাদী গান । তাঁর কৃতকর্মে বিস্মিত ও হতবাক হয়েছিলেন আয়োজক এবং তৎকালীন সংবাদমাধ্যমের লোকজন । তারা ববকে শুধু একটাই প্রশ্ন করেছিলেন -"Why ?" উত্তরে বব মার্লে  বলেছিলেন,"The people, who were trying to make this world worse... are not taking a day off. How can I .... ! ! !"

  একদিকে যখন সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী বিশ্ব বনাম জ্যামাইকান বাফেলোর যুদ্ধ চলছে, তখন গিটার হাতে নিয়ে নিজেই বিপ্লবের প্রতিমূর্তি হয়ে দুর্বল, শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে গেয়েছিলেন "Get up, stand up: stand up for your rights. . . . .Get up, stand up: don’t give up the fight".

  বব মার্লে বিশ্বাস করতেন রাস্তাফারি কালচারে । বব মার্লে বিশ্বাস করতেন ‘রাস্তাফারি’ ধর্মে । মার্লেকে এই ধর্ম নিয়ে তৎকালীন সংবাদমাধ্যমের সাক্ষাৎকারগুলোতে প্রচুর বলতে হয়েছে । বলতে হয়েছে কেন তিনি "রাস্তাফারি"। কেন তিনি "রাস্তাফারি" হয়ে উঠে সাদা-কালো, শোষক-শোষিত বৈষম্যের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে গান বেছে নিয়েছেন । 

  তিনি বলেছেন,"রাস্তাফারি কেবল ধর্ম নয়, তা মানবসভ্যতার ইতিহাসে একটি জাতির ইতিহাস ও ক্ষমতার ‍বিরুদ্ধে একটা লড়াইও বটে । শুধুমাত্র "কালো" বলে আফ্রিকা আজ শোষিত । মহান দেশ ইথিওপিয়া যেখানে শোষিত, সেখানেই রাস্তাফারিয়ানদের যুদ্ধ"।

  শোষিত রাস্তাফারিয়ান ও বব মার্লে বিশ্বাস করতেন, একদিন রাস্তাফারিয়ানদের গড ইথিওপিয়ান সম্রাট হেইলে সালাসসিয়ে কালো মানুষের পক্ষে পুনর্বার জেগে উঠবেন । বব মার্লে জানতেন, কিভাবে দস্যু আমেরিকানরা দখল ও চুরি করে নিয়ে গেছে আফ্রিকানদের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য ।

  তিনি তাঁর গানে বলেছিলেন - “Buffalo Soldier, Dreadlock Rasta: There was a Buffalo Soldier in the heart of America. Stolen from Africa, brought to America. Fighting on arrival, fighting for survival".

  জ্যামাইকান পপ,রেগে গুরু ‘বব মার্লে’ একটি কথা বিশ্বাস করতেন - "মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণা, বর্ণপ্রথা মানুষের মন থেকে একেবারে নির্মূল করা সম্ভব । আর এজন্য মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটাতে হবে, গানের মাধ্যমে ভালোবাসার বীজ বোপন করতে হবে প্রতিটা শোষিত মানুষের অন্তরে । এপ্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন,"Love the life you live, Live the life you love". 

  তিনি বলতেন "আমরা  বড় হতে হতে ভুলে যাই যে জীবন বলে কিছু আছে । জীবনকে ভালোবেসে বেঁচে থাকা বলতে কিছু আছে । জীবনকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়ে বাঁচা বলতে কিছু আছে । আমরা বেঁচে থাকি অন্যের নির্ধারিত নিয়মে এবং আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া হাজারটা অন্যায়ের সাথে আপোষ করে । বেঁচে থাকি লোকলজ্জার ভয়ে, বেঁচে থাকি "মানুষ কি বলবে" এই ভেবে । এভাবেই একদিন মৃত্যু এসে কেড়ে নিয়ে যায় আমাদের জীবন । আমাদের পক্ষে তাই জীবনটাকে ভালোবেসে বেঁচে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না"। 

  মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সেই কোটি কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে পৃথিবী ছেড়ে তাঁকে চলে যেতে হয় ।

  মৃত্যুর পর মার্লের প্রসঙ্গে তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ট একজন পরিচালক কলিন লেস বলেছিলেন,"প্রায় চার হাজারেরও বেশি মানুষকে মার্লে দেখাশোনা করতেন । কোনদিন তাদের অভুক্ত না থাকা এবং সম্মানের সাথে তাদের প্রতিপালন করার ব্যবস্থা করেছিলেন বব মার্লে"।

  মার্লের জীবনী হলো এক বাস্তবতার গল্প । বিপ্লব, রেগে, গাঁজা, ফুটবলপ্রেমী, মানবতাবাদী ও কিংবদন্তি এক রকস্টারের গল্প । যার গান সাদা-কালো মানুষকে এক সাথে বেঁচে থাকার প্রেরণা দেয় । মার্লে নিজে প্রায় পাঁচশ গান লিখেছেন ও সুরারোপ করেছেন । তাঁর গাওয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে অন্যতম হল "গেট আপ স্ট্যান্ড আপ", "বাফেলো সোলজার", "ওয়ান লাভ" ও "নো ওম্যান নো ক্রাই"।

  বিবিসি তার "ওয়ান লাভ" গানটিকে শতাব্দীর সেরা গান হিসেবে নির্বাচিত করে । ১৯৯৯ সালে টাইম ম্যাগাজিন "বব মার্লে অ্যান্ড দ্য ওয়েইলার্স" অ্যালবামটিকে "বিশ শতকের সেরা অ্যালবাম" হিসেবে নির্বাচিত করে । ৬ই ফেব্রুয়ারি বব মার্লের জন্মদিন । দুনিয়ার ইতিহাসে খুব কম শিল্পীকেই মারা যাওয়ার বহু বছর পরও অসংখ্য মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত করা হয়েছে । তাঁর গাওয়া "নো ওম্যান নো ক্রাই" বা "ইজ দিস লাভ"-এর মতাে গানগুলো আজও অসংখ্য শ্রোতাকে মোহাবিষ্ট করে রাখে । তাঁর না থাকার অস্তিত্ব আজও টের পাওয়া যায় টিএসসি-র দেওয়ালে বা যুবকদের টি-শার্টে বব মার্লের ছবি দেখলেই ।

  আজ তাঁর মৃত্যুর চার দশক পার হয়েছে । তবু আজও যেন মনে হয়, বিশ্বমঞ্চে গিটার হাতে বব মার্লে চিৎকার করে শ্রোতার বুকে কাঁপন ধরিয়ে গাইছেন- "জাগো, দাঁড়াও, দাঁড়াও তোমার অধিকারের জন্য, জাগো, দাঁড়াও, ছেড়ে দিও না বন্ধু বাঁচার যুদ্ধ"। 

  মৃত্যুর পর তাঁর গান কোটি কোটি মানুষকে দিয়ে গেছে লড়াই করে বেঁচে থাকার প্রেরণা এবং গিটার হাতে পৃথিবী বদলে দেওয়ার এক দুঃসাহস ।

Post a Comment

0 Comments