আনিস ও তুহিনার বিচারের দাবিতে AIPWA-র প্রেস বিবৃতি
বিশ্বরূপ দে-র প্রতিবেদন
একদিকে যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বারাণসীর কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে গিয়ে শিবের মাথায় দুধ ঢালতে মগ্ন, তখন আরেকদিকে তাঁরই অনুগামীদের দ্বারা ধর্ষণ ও খুনের হুমকি এবং ঘরের দরজায় ক্রমাগত লাথি, অশ্রাব্য গালাগালি এবং বোমাবাজির ভয়ে ঘরের মধ্যেই গলায় দড়ি দিয়ে শেষমেষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হলো বর্ধমান পুরসভার ২৭নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও বর্ধমান রাজ কলেজের বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্রী মাত্র ১৯ বছর বয়সী তুহিনা খাতুন ।
সম্প্রতি পুরসভা নির্বাচনে এই ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রার্থী হন বসির আহমেদ ওরফে বাদশা । কিন্তু তৃণমূলের অপর এক গোষ্ঠীই তাকে মেনে নিতে পারেনি । মুক্তার মিঞা নামের স্থানীয় এক তৃণমূল নেতার অনুগামীরা চরম বিরোধিতা করেন বাদশা ওরফে বসির আহমেদের । তাদের সাফ কথা ছিল, যে ব্যক্তি এলাকায় সমাজবিরোধী কার্যকলাপের জন্য "ডন" হিসেবে পরিচিত, তাকে কখনোই প্রার্থী করা যাবে না । মুক্তার অনুগামীদের সমর্থন করেন তৃণমূলেরই আরেক সমর্থক জুনাই শেখ । আর তারই মাসুল দিতে হলো জুনাই শেখের মেয়ে তুহিনা খাতুনকে ।
গোটা ভোট পর্ব জুড়ে জুনাই শেখ ও তাঁর পরিবারের ওপর নানাভাবে মানসিক নির্যাতন চালাতে থাকে "তোলাবাজ" বসির আহমেদের অনুগামীরা । স্থানীয়দের কথায়, জুনাই শেখের তিন মেয়েকে খুন করে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকে বসিরের গুন্ডাবাহিনী । এমনকি তাঁর বাড়ির দেওয়ালে তিন মেয়ের গাছে ঝুলন্ত মৃতদেহের ছবি এঁকে দেয় তৃণমূল নেতা ও প্রার্থী বসির বাহিনীর কুখ্যাত "শিল্পীরা"। ভোটের ফল বেরোলেই এই ছবি সত্যি হয়ে যাবে বলে প্রকাশ্যে জুনাই শেখকে হুমকি দেয় তারা । আর ঠিক ফল বেরোনোর পরই বিজয়ী প্রার্থী বসিরের লোকজন কথামতো জুনাই শেখের বাড়িতে চড়াও হয় এবং বাড়ির বাইরে বোমাবাজি করতে থাকে । অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে দরজায় ক্রমাগত লাথি মারে এবং জুনাইয়ের তিন মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করার হুমকি দেয় বলে স্থানীয়দের অভিযোগ । বসির বাহিনীর এই তান্ডবের আতঙ্কে একপ্রকার সিঁটিয়ে থাকে সেই সময় ঘরের ভেতর উপস্থিত তাঁর এক মেয়ে তুহিনা । জীবিত থাকলে তাকে বসির বাহিনীর হাতে ধর্ষিতা হয়ে খুন হতে হবে - সেই ভয়, লজ্জা আর অপমানে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হন ১৯ বছরের তুহিনা খাতুন ।
সম্প্রতি আনিস খানের হত্যার বিরুদ্ধে আজও রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে শুরু করে শহর কলকাতার রাজপথ জুড়ে প্রতিবাদী ছাত্রযুব ও গণতান্ত্রিক মহলের মিছিল-সমাবেশ অব্যহত । ছাত্রনেতা খুনের বিচার বিভাগীয় তদন্ত, আসল দোষীদের গ্রেফতার এবং পুলিশমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার সমস্ত বাম ছাত্রযুব সংগঠন । এরই মধ্যে বর্ধমানের তুহিনা খাতুনের মৃত্যুর ঘটনা রাজ্যের শাসকদল কর্তৃক সন্ত্রাসের এক নতুন সংযোজন ।
মর্মান্তিক এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে, শাসকদল আশ্রিত লুম্পেনবাহিনীর দৌরাত্ম ও পুলিশি অপদার্থতার বিরুদ্ধে ৪ঠা মার্চ শুক্রবার এক প্রেস বিবৃতি জারি করলো AIPWA (সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি)।
সংগঠনের রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে উক্ত বিবৃতিতে বলা হয়, "আনিস খানের বিচারের দাবি তুলে যখন বাংলার মানুষ পুলিশের হামলা ও মামলার মোকাবিলা করছে, ঠিক তখনই এই রাজ্যে আরো এক রাষ্ট্রীয় হিংসার ঘটনা ঘটে গেল । বর্ধমানের রাজ কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ১৯ বছরের মেয়ে তুহিনা খাতুনকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে ২৭নং ওয়ার্ডের বিজয়ী কাউন্সিলার তথা তৃণমূলের বাহুবলি নেতা বসির আহমেদ এবং তার সাগরেদরা । ৩রা মার্চ পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর স্থানীয় টিএমসি সমর্থকরা তুহিনার বাড়িতে হামলা চালায় । তুহিনা কিন্তু এই শাসক দলেরই বিরোধী গোষ্ঠির কর্মী । বসির আহমেদের লোকজন তুহিনার বাবা জুনাই শেখকে নির্বাচনে বসিরের বিরোধিতা করার জন্য ভয়ানক পরিণতির হুমকি দেয় । তুহিনার বাড়ির সামনের দেওয়ালে তুহিনাদের তিন বোনকে মেরে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেওয়ার ছবিও এঁকে দেওয়া হয় । টিএমসির কাউন্সিলর নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এই কাজ করেন । দেওয়াল লিখনে তিন বোনের ঝুলন্ত ছবি এঁকে দিয়ে স্পষ্ট বার্তা দিয়ে যায় টিএমসি নেতারা । এছাড়া খুন ও ধর্ষণের প্রকাশ্য হুমকি তো ছিলই । তুহিনার বাবা শাসকদলের নেতার হাত-পা ধরে মেয়েদের প্রাণভিক্ষা করতে গেছিলেন, পাত্তা দেয়নি নেতারা । ভোটে জিতেই বিজয়ী বীরেরা বাড়িতে এসে চড়াও হয় এবং তারপর তুহিনা খাতুনের "ঝুলন্ত মৃতদেহ পাওয়া যায়"। আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয় তুহিনা খাতুনকে । শাসকদলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও বিরোধের কারণে দলের মধ্যেই বিরোধী মতকে স্তব্ধ করতে আজ তৎপর ক্ষমতাশীল শাসকদলের বাহুবলীরা । মেয়েদের ধর্ষণের হুমকি দিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করার মতো ঘৃণ্য অপরাধজনিত অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশকে অবিলম্বে বসির আহমেদ ও তার সাগরেদদের গ্রেফতার করতে হবে"।
পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক সন্ত্রাস নামিয়ে বিরোধী মতের কন্ঠ রোধ করার হিংস্র আক্রমণ বন্ধ করার পাশাপাশি, তুহিনা খাতুন ও আনিস খানের ন্যায় বিচারের দাবি জানিয়েছে AIPWA-র রাজ্য নেতৃত্ব ।
0 Comments