ধর্ষণ ও খুনের সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী - ইন্দ্রানী দত্ত(AIPWA)
বিশ্বরূপ দে : ২০১১-য় তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখলের পর রাজ্যে নতুন করে উত্থান হয়েছে রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও দৌড়াত্বের । গত ৫ই এপ্রিল নদীয়ার হাঁসখালির নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুন এবং তথ্যপ্রমাণ লোপাটের চেষ্টা আবারও প্রমাণ করে দিলো ক্ষমতার দম্ভ শাসক দলকে কিভাবে ভয়ংকর করে তুলেছে ।
গত ৪ঠা এপ্রিল তৃণমুলের দাপুটে নেতা তথা পঞ্চায়েত সদস্য'র ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে নাবালিকা মেয়েটিকে নিমন্ত্রণ করে ডেকে তাকে মদ খাইয়ে ধর্ষণ করা হয় । এরপর ১৪ বছরের নাবালিকাটির রক্তক্ষরণ হতে থাকে এবং শেষমেষ মেয়েটি মারা গেলে কোনরকম ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়াই তাকে শ্মশানে পুড়িয়ে দেওয়া হয় বলে মেয়েটির পরিবারের অভিযোগ ।
অনেকটা একই কায়দায় ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা ঘটেছিল উত্তরপ্রদেশের হাথরসে । ওই ঘটনায় বাংলার মুখমন্ত্রী নিন্দায় মুখর হয়েছিলেন । অথচ নিজের রাজ্যের এই ঘটনা প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছেন "ঘটনাটা খারাপ, কিন্তু ছেলেটার সঙ্গে অ্যাফেয়ার ছিল । এটা ধর্ষণ ! মেয়েটি তো প্রেগন্যান্ট ও হতে পারে ।" কোন তদন্ত ছাড়া রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্য প্রমাণ করে তিনি আসলে অভিযুক্তদের পক্ষেই সাফাই দিচ্ছেন । অ্যাফেয়ার থাকলেই যেন একটি মেয়েকে ধর্ষণ করা যায় ! মুখ্যমন্ত্রী কী জানেন না যে ১৪ বছরের মেয়ে প্রেগন্যান্ট হলে সেটাও ধর্ষণেরই আওতায় পরে !
সম্প্রতি রাজ্যে পুলিশ -প্রশাসন শাসক দলের হাতের পুতুলে পরিনত হয়েছে । বর্ধমানে তুহিনা খাতুন ও তার দুই বোনকে প্রকাশ্যে তৃণমূলের বিধায়ক বসির আহমেদ কর্তৃক খুনের হুমকি, দেওয়ালে বিকৃত ছবি এঁকে ভয় দেখানো এবং তারপরে তুহিনা খাতুনের মৃত্যু । কিন্তু আজও পুলিশ বসির আহমেদ'কে গ্রেফতার করেনি । আমতায় পুলিশি মদতে আনিস খান'কে হত্যা করা হলো । বগটুই গ্রামের তৃণমুলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে পুড়িয়ে মারা হল ৮ জন মহিলা ও একটি শিশুকে । পুলিশ গ্রামে উপস্থিত থেকেও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে । এবার হাঁসখালিতেও দেখা গেল মূল অভিযুক্ত তৃণমূলের নেতার ছেলে । এমনকি ঘটনার পর পরিবারকে চাপ দিয়ে তড়িঘড়ি নাবালিকাটির দেহ দাহ করে তথ্য প্রমাণ লোপাট করার অভিযোগ উঠছে পুলিশের দিকে ।
হাঁসখালির ঘটনায় রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে দোষীদের গ্রেফতার ও বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি তুলেছে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি । ঘটনা প্রসঙ্গে খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে ৫ তারিখের ঘটনায় কেন ১০ তারিখ অভিযোগ দায়ের করা হলো ? মূল অভিযুক্তের বাবা তৃণমূলের দাপুটে নেতা সমর গোয়ালা এখনো কেন পলাতক ? তথ্য প্রমাণ লোপাটের জন্য পঞ্চায়েত ও পুলিশের মদতেই মেয়েটিকে দ্রুত দাহ করে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি AIPWA-(সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি)র ।
অতীতে পার্ক স্ট্রিটে যৌন-হিংসার ঘটনার সময় মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে ভিক্টিমকেই দোষারোপ করার পন্থা নিয়েছিলেন, এক্ষেত্রেও সেই রাস্তায় হেঁটে দেখিয়ে দিলেন যে তাঁর ক্ষমতার চরিত্র পিতৃতান্ত্রিক ও নারী-বিদ্বেষী । ঘটনা প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য এই রাজ্যে ধর্ষক ও খুনিদের বাড়বাড়ন্ত হতে সাহায্য করছে এবং অত্যাচারিতদের বিচারের অধিকার হনন করছে ।
শাসকের এই ক্ষমতার পিতৃতান্ত্রিক আস্ফালনের বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে AIPWA ।
ঘটনার পর ১২ই এপ্রিল সিপিআই (এমএল) লিবারেশন ও AIPWA-র পক্ষ থেকে একটি পর্যবেক্ষক দল নদীয়ার হাঁসখালিতে গিয়ে জানতে পারেন যে, নির্যাতিতার পরিবার শাসকদলের সন্ত্রাসের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল । রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় এই ঘটনার প্রতিবাদের ফলস্বরূপ কিছুটা স্বাভাবিক হয় পরিস্থিতি এবং নির্যাতিতার পরিবার গ্রামে ফিরে আসতে সক্ষম হয় ।
এবিষয়ে এক প্রেস বিবৃতি জারি করে AIPWA-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদিকা কমরেড ইন্দ্রানী দত্ত বলেন,*"আমরা মনে করি হাঁসখালির ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে ধর্ষণ ও হত্যার মতো নৃশংস অপরাধকে লঘু করতে চেয়েছেন । তাঁর ওই বক্তব্য নির্যাতিতার চরিত্র হনন করেছে ও বাংলায় ধর্ষণ ও খুনের সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে । হাঁসখালি থেকে শুরু করে বোলপুর, কাকদ্বীপ, উত্তর-দিনাজপুরের একের পর এক ধর্ষণ কান্ডের খবর সামনে আসায় বোঝা যাচ্ছে হাঁসখালি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । বরং ভিক্টিমকে দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাজ্যে স্বৈরাচারী গুন্ডারাজ ও পিতৃতান্ত্রিক ধর্ষণ-সংস্কৃতিকে কায়েম করার চেষ্টা করছে শাসকদল তৃণমূল"*।
রাজ্যজুড়ে ধর্ষণ, খুন ও পুলিশি হয়রানির বিরুদ্ধে এবং শাসকের এই পিতৃতান্ত্রিক আস্ফালনের প্রতিবাদে AIPWA-র পক্ষ থেকে কলকাতা, হুগলি, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা, হাওড়া সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হয় ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ, এই ঘটনার তদন্তভার সিবিআইকে দিয়েছে হাইকোর্ট । ১৪ই এপ্রিল আইএসএফের বিধায়ক মহঃ নওসাদ সিদ্দিকী হাঁসখালি গিয়ে নির্যাতিতার পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেন । রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করে তিনি বলেন,"এই মৃত্যু নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ওই বক্তব্য খুবই নিন্দাজনক"। মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসে ধর্ষণকারীদের প্রতি কঠোর হওয়ার বদলে তিনি তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন ভাঙরের বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকী ।
হাঁসখালি সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ধর্ষণ, খুন ও শাসকদলের সন্ত্রাসের প্রতিবাদে কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলাজুড়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি সংঘটিত করে পশ্চিমবঙ্গ মহিলা সমিতি, SFI, DYFI, AIYF, AISA ও IPC-র সকল কর্মী ও নেতৃবৃন্দ ।
0 Comments