লোকসঙ্গীত শিল্পী অমর পালের জন্মশতবর্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য
বিশ্বরূপ দে-র বিশেষ প্রতিবেদন
"দেখো ভালো জনে রইলো ভাঙা ঘরে, আর মন্দ যে জন সিংহাসনে চড়ে । সোনার ফসল ফলায় যে তার, দুই বেলা জোটেনা আহার । হীরার খনির মজুর হয়ে কানাকড়ি নাই, ভাইরে ভাই, কতোই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়".....। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিত রায়ের এই অমর কথাগুলি যার কন্ঠে বাঙালির মনে আজও অমর হয়ে আছে তিনি লোকসঙ্গীত শিল্পী অমর পাল ।
যে সকল শিল্পীরা বাংলায় লোকসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম এবং অগ্রগণ্য অমর পাল ।
সত্যজিৎ রায় উপরে উদ্ধৃত এই গানটির জন্য খুঁজছিলেন এমন এক কণ্ঠ, যাতে থাকবে মাটির টান, মাটির গন্ধ । সেই টান আর দরদ দিয়েই গানটি গাইলেন অমর পাল । তারপর বাকিটা ইতিহাস । আজও বাঙালির প্রাণ নেচে ওঠে ওই সুরে, শাসকের বুকে ধাক্কা মারে ওই কন্ঠে গাওয়া গানটির প্রতিটি কথা । কিন্তু এছাড়াও বাংলাকে অনেক কিছু দিয়েছেন তিনি । রেডিওর যুগে তাঁর কণ্ঠে ঘুম ভাঙত বাঙালির । প্রভাত সময়ে "শচীর আঙিনা মাঝে গৌর চাঁদ নাচিয়া বেড়ায়", আবার লালন ফকিরের সম্প্রীতির গান - তাও তাঁরই কন্ঠে । সারা জীবন বহু গান গেয়েছেন তিনি । তাঁর গাওয়া কীর্তন, বাউল, ভাটিয়ালি প্রাণ ভরিয়েছে আপামর বাঙালির ।
সারাজীবন ধরে আমাদের বিভিন্ন ধারার শিকড়ের গানকে উপহার দিলেও বাংলা লোকসঙ্গীত প্রিয় মানুষের হৃদয়ে অমর পালের কন্ঠে প্রভাতী ও ভাটিয়ালী গান যেন এক অন্যমাত্রা পায় ।
১৯২২ সালের ১৯শে মে ব্রাহ্মণবেড়িয়ায় জন্ম অমর পালের । মা দুর্গাসুন্দরী দেবীর কাছে লোকসঙ্গীতে হাতেখড়ি হয় তাঁর । মাত্র ১০ বছর বয়সেই বাবা মহেশ চন্দ্র পালকে হারান তিনি । এরপর সংসারের ভার তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেন । ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন গানপাগল । আট বছর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-এর ছোট ভাই আয়েত আলি খাঁ-এর কাছে ।
১৯৪৮ সালে আকাশবাণীর গীতিকার শচীন্দ্র নাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে কলকাতায় যান অমর পাল । সেখানে বেঙ্গল মিউজিক কলেজের অধ্যাপক মণি চক্রবর্তী, সুরেন চক্রবর্তী, ননীগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে নতুন করে লোকসঙ্গীত শেখেন । আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের লোকসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে অমর পাল বেতারে প্রথম লোকসঙ্গীত পরিবেশন করেন ১৯৫১ সালে ।
তাঁর গাওয়া অসংখ্য গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে । পাশাপাশি তিনি একাধিক চলচ্চিত্রের গানেও কণ্ঠ দেন । দেবকী কুমার বসু, সত্যজিৎ রায়, ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিতে গান গেয়ে দারুণ প্রশংসিত হন তিনি । সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে তাঁর গাওয়া ‘আমি কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়’ এখনো জনপ্রিয় ।
অমর পালের গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে রয়েছে ‘প্রভাত সময়ে’, ‘জাগো হে এ নগরবাসী’, ‘রাই জাগো’, ‘প্রভাতে গোবিন্দ নাম’, ‘রাই জাগো গো’, ‘ভারতী গৌরাঙ্গ লইয়া’, ‘হরি দিন তো গেল’, ‘মন রাধে রাধে’, ‘বৃন্দাবন বিলাসিনী’, ‘জাগিয়া লহো কৃষ্ণ নাম’, ‘আমার গৌর কেনে’, ‘আমি কোথায় গেলে’ ইত্যাদি ।
বাংলা তথা দেশের বাইরেও তাঁর সঙ্গীত অনুষ্ঠান টোকিও, বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সঙ্গীত সম্মেলন এবং কর্মশালায় প্রশংসিত হয়েছে ।
শিল্পী অমর পাল কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সঙ্গীত একাডেমির ভাইস চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন । বাংলার লোকসঙ্গীত ক্ষেত্রে তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ স্টেট একাডেমী অফ ডান্স, মিউজিক এন্ড ভিসুয়াল আর্টস, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ সঙ্গীত একাডেমী দ্বারা সম্মানিত হন তিনি ।
ভারত সরকারের সঙ্গীত-নাটক আকাদেমি পুরষ্কার সহ, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লালন পুরষ্কার ও সঙ্গীত মহাসম্মান পেয়েছেন লোকসঙ্গীত শিল্পী অমর পাল । বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে । ২০১৯ সালের ২০শে এপ্রিল তাঁর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ হয় দেশ-বিদেশের অসংখ্য সঙ্গীত শিল্পী । কিন্তু আজও প্রতিটা লোকসঙ্গীত প্রিয় মানুষের হৃদয়ে চির অমর হয়ে রয়েছেন শিল্পী অমর পাল ।
0 Comments