বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধার্ঘ্য
বিশ্বরূপ দে-র বিশেষ প্রতিবেদন
বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম । একাধারে একজন সাহিত্যিক, কবি, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংবাদিক, দক্ষ সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সর্বদাই উচ্চকণ্ঠ ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম ।
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে মে বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল । তিন পুত্র ও এক কন্যা নিয়ে একপ্রকার অসচ্ছল সংসার ছিল নজরুলের বাবা অর্থাৎ ফকির আহমেদ এবং মা জাহেদা খাতুন বিবির । অভাবের সংসারে জন্ম হয়েছিল বলে কবি নজরুলের ডাক নাম ছিল দুখু মিঞা । মাত্র নয় বছর বয়সেই বাবাকে হারান নজরুল ।
গ্রামের মৌলবী কাজী ফজলে আহমেদের কাছে নজরুলের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় । অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন কবি । কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরতে ওই ছোট্ট বয়সেই জীবিকার সন্ধানে নামতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি । কিন্তু আর্থিক অনটন লেখাপড়ার প্রতি তাঁর আগ্রহ কমাতে পারেনি । ছেলেবেলাতেই তিনি কুরআন, রামায়ণ ও মহাভারত, পুরাণ কাহিনী পড়ে জ্ঞান অর্জন করেন । পাশাপাশি, আরবী ও ফরাসী ভাষাকেও আয়ত্তে আনেন কবি ।
তাঁর পরবর্তী শিক্ষাজীবন শুরু হয় রানীগঞ্জের সিয়ারশোল স্কুলে । সেখানকার অধ্যয়ন শেষ করে ভর্তি হন বর্ধমানের মাথরুন উচ্চ বিদ্যালয়ে । আর ঠিক এই সময়তেই সংসারের চরম দারিদ্র তাঁর শিক্ষালাভের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় । শেষমেষ লেখাপড়া ছাড়তে বাধ্য হন কাজী নজরুল ।
রোজগারের তাড়নায় কবি যুক্ত হলেন কবিগানের দলে এবং নিজেই গান লেখা ও সুর দেওয়া শুরু করেন । সেই সময় তিনি অনেক সুফী, ফকির, বাউল ও সাধু-সন্যাসীদের সংস্পর্শে আসেন । গানের দল থেকে সামান্য রোজগার ও ঐসকল গুণীজনের প্রেরণায় কবি পুনরায় লেখাপড়ার জন্য ভর্তি হলেন রানীগঞ্জের সিয়ারশোল স্কুলে । সেখানে কবির দশম শ্রেণীর ছাত্রাবস্থায় শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ । তখন পড়াশুনা ছেড়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন তিনি । শুরু হলো কাজী নজরুল ইসলামের সৈনিক জীবন ।
১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হয় । সেই সময়ে স্বদেশে ফিরে আসেন নজরুল । যুদ্ধের রক্তাক্ত স্মৃতি তাঁর চেতনায় জেগে ওঠে । তখন থেকেই শুরু হয় তাঁর জীবনের আরেকটি নতুন অধ্যায় ।
তিনি অনুভব করতে শিখলেন পরাধীনতার অপমান । যুদ্ধ চলাকালীনই তিনি লিখেছিলেন "বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী" এবং "রিক্তের বেদন" নামে দুটি উপন্যাস । বলতে গেলে যুদ্ধের শেষে স্বদেশে ফিরে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বাংলা কাব্য ও সাহিত্যের জগতে নিয়োজিত করেন । বুঝতে পারলেন কবিতা আর গান অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আওয়াজ তোলার উপযুক্ত অন্যতম মাধ্যম ।
ওই সময়ে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিভা উজ্জ্বল তারকার মতো অন্যান্যদের আড়াল করে রেখেছিল । কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের লেখার মধ্যে এমন এক প্রাণ ও প্রতিবাদী কন্ঠ গর্জে উঠলো যা বাঙালি পাঠকগনের চিন্তা ও মননে স্থান করে নেয় ।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দে "মুসলিম ভারত" পত্রিকায় তাঁর লেখা "বিদ্রোহী" কবিতাটি প্রকাশিত হয়, যা সারা ভারতের সাহিত্য সমাজে খ্যাতিলাভ করে । এই কবিতাটিই তাঁকে বাংলা কাব্যে বিজয়ীর গৌরব ও সম্মান প্রদান করে । কারণ এহেন কবিতা এর আগে কেউ লেখেন নি । ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ই আগস্ট নজরুল "ধূমকেতু" পত্রিকা প্রকাশ করেন । এটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো । সে বছরই তাঁর প্রবন্ধ "যুগবানী" ইংরেজ সরকার বাজেয়াপ্ত করে এবং ওই একই দিনে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয় । কারাগারের ভেতর ইংরেজ পুলিশের নানা অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি আমরণ অনশন শুরু করলেন । যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরোধে তিনি অনশন প্রত্যাহার করেছিলেন । কিন্তু সৃষ্টির ধারা অব্যহত রেখেছিলেন । একে একে প্রকাশিত হয় তাঁর "অগ্নিবীণা", "দোলনচাঁপা", "ভাঙা গান", "বিষের বাঁশি", "সর্বহারা" ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ । একই সাথে রচনা করেন অসংখ্য গান ।
বিদ্রোহী কবি যখন সকল সাধনার উর্দ্ধে, তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে একটি অনুষ্ঠান চলাকালীন হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন কাজী নজরুল ইসলাম । হারিয়ে ফেলেন বাকশক্তি । বহু চেষ্টা করেও তাঁর বাকশক্তি ফিরিয়ে আনা যায়নি । চিকিৎসকগন জানিয়েছিলেন যে কোন এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি । দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরও তাঁকে সুস্থ করে তোলা যায়নি ।
অবশেষে একদিন এলো চির বিদায়ের ক্ষন । ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে আগস্ট ৭৭ বছর বয়সে সকলকে কাঁদিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম । কবির মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ হয়েছিল আপামর জনসাধারণ ।
0 Comments