ব্রেকিং নিউজ

6/recent/ticker-posts

প্রতিটা ভাস্কর্যে আজও জীবিত রামকিঙ্কর বেইজ

ভারতীয় ভাস্কর্যশিল্পে আধুনিকতার জনক রামকিঙ্কর বেইজ



বিশ্বরূপ দে-র বিশেষ প্রতিবেদন 

   রামকিঙ্কর বেইজ ছিলেন প্রথম ভারতীয় শিল্পী, যিনি আধুনিক পাশ্চাত্য শিল্প অধ্যয়ন করে সেই শৈলী নিজের ভাস্কর্যে প্রয়োগ করেন । সেইজন্য তাঁকে ভারতীয় ভাস্কর্য শিল্পে আধুনিকতার জনক এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসেবে গণ্য করা হয় । তিনি ছিলেন আধুনিক ভারতীয় ভাস্কর্যশিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অগ্রপথিক । 

  ১৯০৬ সালের ২৫শে মে ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির বাঁকুড়া শহরের যুগীপাড়ায় (অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ) এক পরমানিক (নাপিত) পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রামকিঙ্কর বেইজ । তাঁর পদবী বেইজ, যা সংস্কৃত বৈদ্য ও প্রাকৃত বেজ্জ-র পরিবর্তির রূপ । পিতা ছিলেন চণ্ডীচরণ বেইজ ।

  মধ্যকৈশোরে রামকিঙ্কর অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি আঁকতেন । মেট্রিক ক্লাস (বর্তমানে যা মাধ্যমিকের সমতুল্য) পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর ষোলো বছর বয়সে তিনি বাঁকুড়ার বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং "প্রবাসী" পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের নজরে পড়ে যান । চার বছর পরে তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র হিসেবে যোগ দেন । আচার্য নন্দলাল বসু ছিলেন তাঁর শিক্ষক । রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় প্রমুখকে সহপাঠী হিসাবে পেয়েছিলেন রামকিঙ্কর । চারুকলায় ডিপ্লোমা অর্জন করে তিনি বিশ্বভারতীর ভাস্কর্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদে নিযুক্ত হন । বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী জহর দাশগুপ্ত, শঙ্খ চৌধুরী ছিলেন তাঁর ছাত্র । ১৯৭১ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন ।



  রামকিঙ্কর বেইজ তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে জীবনের প্রাকৃতিক উৎসতে সাড়া দিয়েছিলেন । মানব ব্যক্তিত্ব, দেহের ভাষা এবং সাধারণ মানব-নাটকে খুব আগ্রহী ছিলেন তিনি । আধুনিক পশ্চিমা শিল্প এবং প্রাক ও উত্তর-শাস্ত্রীয় ভারতীয় শিল্প তাঁর উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল । তিনি স্থানীয় উপাদানগুলি শিল্পসৃষ্টির সুবিধার্থে ব্যবহার করেছিলেন এবং একজন মডেলার এবং কার্ভারের দক্ষতার সংমিশ্রণে কাজ করতেন । তাঁর চিত্রগুলিও তাঁর ভাস্কর্যগুলির মতো প্রকাশবাদী মাত্রা গ্রহণ করে, যা শক্তি এবং প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ ।

  বেইজ যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিকৃতি তৈরি করছিলেন, তখন এক বৈঠকের সময়, প্রবীণ কবি তাঁকে বাঘ হিসেবে এই বিষয়টির কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে রক্তে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন । এর পরে, বেইজের নিজস্ব কথায়, তাঁকে "কখনো পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি"।

  তাঁর কয়েকটি ভাস্কর্য কলাভবন - শান্তিনিকেতন, প্রয়াত রানী চন্দ সংগ্রহশালা ও চারুকলা একাডেমী, কলকাতা সহ বিভিন্ন স্থানে সংরক্ষিত এবং প্রদর্শিত রয়েছে । কেজরিওয়াল কালেকশন এবং কর্ণাটক চিত্রকলার পরশহাট- বেঙ্গালুরু, ললিত কলা আকাদেমি - নয়াদিল্লি, ন্যাশনাল গ্যালারী অফ মডার্ন আর্ট - নয়াদিল্লি, রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া - নয়াদিল্লি, জেন এবং কিতো ডি বোয়ার - দুবাই এবং নয়াদিল্লির দিল্লী আর্ট গ্যালারীতে তাঁর বহু শিল্পকলা প্রদর্শিত আছে ।

  বয়সকালে প্রোস্টেট গ্রন্থির রোগে আক্রান্ত রামকিঙ্কর বেইজকে ১৯৮০ সালের ২৩ শে মার্চ, কলকাতার পিজি হাসপাতালে (এসএসকেএম) ভর্তি করা হয়েছিল । তাঁর চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করেছিল তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং বিশ্বভারতী । কিন্তু চিকিৎসকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও তাঁর শেষরক্ষা করা সম্ভব হয়নি । ১৯৮০ সালের ২রা আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয় । তাঁর মরদেহ দাহ করা হয়েছিল শান্তিনিকেতনে । হাসপাতালে থাকার সময় তাঁর শেষ ভাস্কর্য ছিল একটি দূর্গামূর্তি । 

  সেদিন মৃত্যু হয়েছিল রামকিঙ্কর বেইজ নামে এক ব্যক্তির, কিন্তু তাঁর শিল্পকলা আজও জীবিত । সেই ভাস্কর্যশিল্পের প্রতিটাতেই জীবিত আছেন ভারতীয় ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজ, বেঁচে আছেন সৃষ্টিতে, বেঁচে থাকবেন প্রতিটা সৃষ্টিকামী মানুষের অন্তরে ।

Post a Comment

0 Comments