ব্রেকিং নিউজ

6/recent/ticker-posts

জীবদেহের পঞ্চভূত তত্ত্ব

বিজ্ঞানের ভাষায় যা এনাটমি, আধ্যাত্মিকতার ভাষায় তা পঞ্চভূত বা "পঞ্চভৌতিক ব্যোমতত্ত্ব"

তথ্য ও গবেষণা

মহঃ এন্থনি বোস

         জীবদেহ গঠনের মূলে ৫টি ভূত রয়েছে । এই পঞ্চভূতের সমন্বয়েই গঠিত আমাদের মানব দেহ । আধ্যাত্মিকতার ভাষায় তাদেরকে সংক্ষেপে "পঞ্চ মহাভূত" আখ্যা দেওয়া হয়েছে । সেই পঞ্চ মহাভূত গুলো হলো --

(১) ক্ষিতি অর্থাৎ ভূমি, 

(২) অপ অর্থাৎ জল,

(৩) তেজ, 

(৪) মরুৎ অর্থাৎ বায়ু এবং  

(৫) ব্যোম 


এবার এগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যায় আসা যাক -


(১) ক্ষিতি অর্থাৎ ভূমি:- এই ভূমি হতেই কিন্তু জীবের চৰ্ম্মমাংসাদি সমন্বিত মানব শরীর সংস্থান সঙ্ঘটিত হয়ে থাকে । অর্থাৎ, ধরিত্রী প্রতিনিয়ত জীব সকলকে তাঁর বুকে ধারণ করে চলেছেন । আবার বিপরীতে মানবজাতিই কিন্তু এই ধরিত্রীর বুকে মৎস্য পালন ও প্রজনন, বিভিন্ন প্রজাতির গবাদি পশু পালন, বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষাদি রোপণ, ফসল ফলানো, খেলাধুলা করা, বসবাস করা, মলমূত্র ত্যাগকরা থেকে আরম্ভ করে আরও নানা কর্ম করে থাকে । 

  ধরিত্রী অর্থাৎ ভূমিই হলো সমগ্র জীব জগতের পালন কর্তা । আবার সেই ভূমিই কিন্তু জীবজগৎ ধ্বংসের প্ৰধান কারণ । 

  এই ভূমির অমাত্ম হলো নাসিকা । এর দ্বারা মানবদেহের পুষ্টি সাধন হয়ে থাকে । নাসিকার গুণ হলো ঘ্রাণ গ্ৰহণ, যার উৎপত্তিস্থল এই পৃথিবী ।


(২) অপ অর্থাৎ জল:- জল মানুষের শরীরের শুক্ৰ, মজ্জা, মেদ এবং ত্বক, সন্ধিস্থিতস্নেহ, ও রুধিরের মধ্যে প্রবাহ উৎপন্ন করে । তার ফলে অমৃতবৎ পদার্থের সমন্বয়ে মানব শরীর তাকে পোষণ করে । সেই কারণে মানুষের শরীরে জলীয় অংশ অপসৃত হলে তৃষ্ণা জন্মায় । আর রক্ত তারল্যের অভাবেই পৃথিবীতে মানবের মৃত্যু ঘটে । সে জন্যই জলের অপর নাম জীবন । আর জিহ্বাই কিন্তু এর অমাত্ম বুদ্ধির প্রেরণায় বাক্য উচ্চারণ করতে সহায়তা করে । আস্বাদ গ্রহণ করাই এর প্রকৃত গুণ । তাই তার নাম বাগিন্দ্ৰিয়, অপ বা জল হলো এর জনক । জলীয় অংশ প্রধান মনুষ্যের দেহেই লক্ষ্মী, তৃপ্তি, যশ, ও কীৰ্ত্তি সর্বদাই নিয়ত থাকে । সেই কারণেই মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বেঁচে থাকার জন্য এই জলের বিকল্প কিন্তু আর কোন কিছুই হতে পারে না ।


(৩) তেজ:- তেজ হলো ধরাধামের সকল মানুষের চৈতন্য সহগামী ও জীবনী শক্তির অনুমাপক । তেজের অভাবে একমাত্র ইহ জগতের মানুষ মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নেয় । একমাত্র চক্ষুদ্বয়ই হলো মানব দেহে এই তেজের অমাত্ম । তার কারন, কেবল চক্ষু দ্বারাই বিশ্ব চরাচরকে দেখতে পাওয়া যায় । রূপ গ্ৰহণ হলো এর আসল গুণ । বুদ্ধি কর্ত্তৃক প্রেরিত হয়েই কিন্তু মানুষের এই তেজ সদা সর্বদা তার সকল কাৰ্যকে সম্পাদন করে থাকে । তৈজসাংশ প্রধান শরীরে, প্ৰতাপ, শৌৰ্য্য, বীৰ্য্য, উৎসাহ ও আত্ম নির্ভরতা সবথেকে প্রবল পরিমাণে থাকে । তাই ধরাধামের যে মানুষের দেহে তেজ নেই তাকে মৃত বলে ঘোষণা করে হয় ।

(৪) মরুৎ অর্থাৎ বায়ু:- বায়ু তার কাৰ্য ও কারণ ভেদে পঞ্চবিধ প্রকারের । সে গুলো হলো যথাক্রমে (১) প্ৰাণ, (২) অপান, (৩) ব্যান, (৪) উদান ও (৫) সমান । 

  জীবদেহের উর্দ্ধদিকে গমনশীল নাসা গ্রস্থায়ী বায়ুর নাম হলো প্ৰাণ । আর অধোদিকে গমনশীল পায়ু স্থানীয় বায়ুর নাম হলো অপান । মানবদেহের সকল নাড়ীতে গমনশীল কণ্ঠস্থানীয় উৎক্রমণ বায়ুর নামই হলো উদান । আর ভুক্ত অন্ন , জলাদি সমীকরণকারী বায়ুর নাম হলো সমান । 

  এতদ্ভিন্ন আরো ৫টি বায়ুও বিদ্যমান, তাদের নাম যথাক্রমে - 

(১) নাগ, 

(২) কুৰ্ম্ম, 

(৩) কৃকর, 

(৪) দেবদত্ত ও 

(৫) ধনঞ্জয়  

এদের কাৰ্য হলো যথাক্রমে 

(১) উদিগরণ, 

(২) চক্ষু উন্মীলন, 

(৩) ক্ষুধার উদ্রেক, 

(৪) জৃম্ভণ ও 

(৫) দেহের পুষ্টি সাধন 

  এই নাগাদি ও প্ৰাণাদি সকলই কিন্তু বায়ুর অন্তর্ভুক্ত । তাদের উপস্থিতি প্রতিটি কাৰ্যেই সুস্পষ্ট বোধগম্য হয় । গমনাদি ক্রিয়াই এই প্ৰাণাদি পঞ্চবায়ুর স্বভাব । অতপ কারণেই কিন্তু রজঃ অংশের অনুমান হয় । আসলে কিন্তু এই বায়ু হতেই মানুষের শুভা শুভ ও জীবন ধারণ করা সম্ভব হয় । বায়ুই প্রকৃত পক্ষে সকল জীবের শরীরের সমস্ত কাৰ্যের সমাধান কৰ্ত্তা । আর জীবদেহের ত্বক্‌ই হলো এর অমাত্ম । আর স্পর্শ হলো এর গুণ, অর্থাৎ মহাপ্রভাব । বায়ুর প্রভাবে জীবদেহ সব সময়ই সবল ও সুস্থ থাকে । একেই কিন্তু আবার স্পর্শেন্দ্ৰিয় বলে । এই রূপ বায়বীয় অংশপ্রধান মনুষ্যগণই আসলে উৎসাহ সমন্বিত ও প্রিয় দর্শনীয় হয় । 

  এই বায়ুই আবার সমস্ত জীব জগতের এক দিকে সৃজন ও পালন এবং অপর দিকে বিনাশেরও কর্ত্তা ।


(৫) ব্যোম:- এই ব্যোম প্রতিটি জীবদেহের বাহ্য, অভ্যন্তরে অবকাশ প্ৰদান করাই কিন্তু এর প্রধান কাজ । আর এই ব্যোমের বাসস্থান হলো শূন্য আকাশ । কেবল মাত্র সকল মানুষের দেহের শ্রবণ যুগলই এর অমাত্ম । আবার এই শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের অভাব হলেই মনুষ্যগণ একেবারেই বধীর হয়ে যায় ।  

  আকাশের প্রধান গুণই হলো শুধুমাত্র শব্দ । অতপ কারণে আকাশংশ-প্রধান মনুষ্যগণই কিন্তু আমাদের ধরাধামে একেবারেই সর্ব সম্পত্তির নিদান হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকেন । ধরাধামের যে ব্যক্তি তার নিজের কান দুটোতে একেবারে কোন কিছুই শুনতে পান না, অতুল ঐশ্বর্য থাকা সত্ত্বেও কিন্তু তিনি কখনোই তার এই মানব জীবনে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারেন না ।

  এই পঞ্চভৌতিক উপাদানের দ্বারাই জীবদেহ বা মানবদেহের সৃষ্টি হয়েছে । আবার অন্তিমকালে শব দেহটি এই পঞ্চভূতেই লয় হয়ে যায় । 

  ধরাধামে জীবিত থাকা কালীন সময়ে মানুষের জন্মের পরথেকে দেহবৃদ্ধি, আহার-নিদ্রা যা কিছু প্রয়োজনীয়, তার সকলই কিন্তু এই পঞ্চভূতের লীলা বা কার্য ভিন্ন অসম্ভব । পরমেশ্বরের সৃষ্ট এই লীলা ভূমিতে "পঞ্চ মহাভূত" কিন্তু তাঁরই ইশারায়, এমনকি তাঁরই ইচ্ছায় মানুষের দেহকে সচল রাখার নিমিত্তে সকল কর্ম সম্পাদন করে । আবার তাঁর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য সময় হলে এই পঞ্চভূতই ধরাধামে মানুষের দেহে তার সকল প্রকার কর্ম থেকে সরাসরি অব্যাহতি নেন । 

  অতপ কারণে এই পঞ্চভূত ভিন্ন যেমন কোনো মানুষের দেহের সৃষ্টি হয়নি । তেমন আবার সময় হলেই ধরাধামের প্রতিটা জীবদেহ এই পঞ্চভূতেই লয়প্রাপ্ত বা বিলীন হয়ে যায় ।

  এই পঞ্চভৌতিক ব্যোমতত্ত্বের মূল বিষয়বস্তু অর্থাৎ মানুষের এই দেহযন্ত্র বা দেহের সম্পূর্ণ অবকাঠামোটি যদি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এনাটমি হয়, তাহলে আধ্যাত্মিক পরিভাষায় এই "পঞ্চভৌতিক ব্যোম তত্ত্ব"টি অবশ্যই ফিজিওলজি । 

  মানবদেহের এই আভ্যন্তরীন রস নিঃসরণ প্রক্রিয়া, আধ্যাত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে তার ক্রিয়া বিক্রীয়া অর্থাৎ "Internal chemical changes" হচ্ছে একটি "পঞ্চভৌতিক ব্যোম তত্ত্ব"। যা অবশ্যই একটি সুক্ষ্ম দেহতত্ত্ব বিজ্ঞান । এটিকে অস্বীকার করার মতো কোন তত্ত্ব, তথ্য বা যুক্তির খোঁজ করা কোন সৎজ্ঞানী মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় ।

Post a Comment

0 Comments