আলিপুর আদালতে পরপর পাঁচটি গুলি করে হত্যা করেন বিচারপতি গার্লিককে
বিশ্বরূপ দে-এর বিশেষ প্রতিবেদন
দিনটা ছিল ২৭শে জুলাই ১৯৩১ । ঠিক সকাল দশটা । একটা কালো অস্টিন গাড়ি ঢুকলো আলিপুর কোর্ট চত্বরে । সামনের আসনে বসা দেহরক্ষী নেমে দরজা খুলে দিতেই চকচকে বুট পরা পায়ে গাড়ি থেকে নামলেন বিচারপতি গার্লিক । কদিন আগেই রাইটার্স বিল্ডিং অলিন্দ যুদ্ধের নায়ক বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন এই বিচারপতি । তারও আগে চট্টগ্রামের আরো এক কিশোর রামকৃষ্ণ বিশ্বাসকেও ফাঁসি কাঠে ঝুলিয়েছেন এই গার্লিক ।
একের পর এক বিপ্লবীদের ফাঁসি কাঠে ঝোলানোর পুরষ্কার স্বরূপ বড়লাটের অভিনন্দন পেয়ে সকাল থেকেই মনটা তার খুশি খুশি । গুনগুন করে একটা গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে পা দিলেন আদালতের সিঁড়িতে । দু-তিন ধাপ উঠেছেন সবে, অমনি ওপরের থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো এক রোগাটে গরনের কিশোর । বিস্ময়ে হতবাক জজসাহেব দেখেন সে দুহাতে পিস্তল উঁচিয়ে তাক করেছে তারই দিকে । চিৎকার করার আগেই পরপর পাঁচটা বুলেট ফুঁড়ে দিল তার বুক ও পেট । বিচারকের ভবলীলা সাঙ্গ । সম্পন্ন হলো গার্লিকের শেষ বিচার !
ততক্ষণে দেহরক্ষীও ওই কিশোরকে লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি চালিয়েছে । আহত অবস্থায় লুটিয়ে পরেই সে পকেট থেকে সায়ানাইড ক্যাপসুল বের করে মুখে পুরে দিল, আর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মৃতদেহ ঢলে পড়লো আদালতের সিঁড়ির ওপর ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন কুখ্যাত টেগার্ট সহ তৎকালীন কলকাতা পুলিশের বাঘা গোয়েন্দারা , তল্লাশি চালিয়ে কিশোরের পকেট থেকে পাওয়া গেল একটা নোটবুক । তাতে লেখা,
"Get destroyed, get the award for hanging Dinesh Gupta". নীচে সই - বিমল দাশগুপ্ত ।
তবে এই কি সেই বিমল ! যাকে মেদিনীপুরের জেলাশাসক পেডি হত্যার জন্য পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে ?
বিনয়-বাদল-দীনেশ-এর কথা আমরা সবাই জানি, কিন্তু বিস্মৃতির পলিতে ঢাকা পড়েছেন অগ্নিযুগের এই বলিপ্রদত্ত বিপ্লবী । তাঁর প্রসঙ্গে যেতে হলে আগে বলতে হবে রাইটার্স বিল্ডিং-এর অলিন্দ যুদ্ধের কথা ।
১৯৩০-এর ৮ই ডিসেম্বর, রাইটার্সে ঢুকলেন বিনয়কৃষ্ণ বসু‚ বাদল গুপ্ত এবং দীনেশ গুপ্ত । তিনজনের পরনেই সাহেবী পোশাক। গেটের রক্ষীরা বুঝতেই পারল না তিন বিপ্লবীর ছদ্মবেশ । সেদিন তাঁদের নিশানায় ছিল ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল সিম্পসন । স্বদেশীদের উপর নির্মম অত্যাচারের জন্য কুখ্যাত ছিলেন এই ইংরেজ তনয় । সরাসরি গুলি করে তাঁকে হত্যা করেন বিনয়-বাদল-দীনেশ । নিমেষের মধ্যে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ হলো রাইটার্স, তারপর শুরু হলো রাইটার্স বিল্ডিং-এর অলিন্দে এক রক্তক্ষয়ী লড়াই । একদিকে বিনয়-বাদল-দীনেশ, অন্যদিকে টেগার্টের নেতৃত্বে সশস্ত্র গোর্খা বাহিনী । ইংরেজ পুলিশের হাতে কিছুতেই ধরা দেবেন না বলে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মঘাতী হন বাদল, বিনয় ও দীনেশ নিজেদের গুলি করেন । পাঁচ দিন পরে হাসপাতালে মৃত্যু হয় বিনয়ের । ভয়াবহ আহত হলেও প্রাণে রক্ষা পান দীনেশ । তাঁকে ১৯৩১-এর ৭ জুলাই ফাঁসি দেওয়া হয় । মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি গার্লিক ।
এর ঠিক বিশ দিন পর‚ ২৭শে জুলাই আলিপুর আদালতের মধ্যেই বিচারপতি গার্লিককে গুলি করে হত্যা করেন এক কিশোর বিপ্লবী । ব্রিটিশদের হাতে ধরা দেবেন না‚ পণ করেছিলেন বছর বাইশের এই বিপ্লবী । গার্লিক লুটিয়ে পড়লে আগে নিশ্চিত হন তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে কিনা, তারপর "বন্দে মাতরম" বলে মুখে পুরে দেন পটাশিয়াম সায়ানাইডের ক্যাপসুল ।
পুলিশ যখন বিপ্লবীর দেহ উদ্ধার করে, তখন তার পকেটে পাওয়া গেল একটা চিরকুট তাতে সই ছিল "বিমল দাশগুপ্ত", যিনি হত্যা করেছিলেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট প্যাডি সাহেবকে ।
পুলিশের ধারণা এই সেই বিমল দাশগুপ্ত, আসলে ওই কিশোর ছিল তৎকালীন অবিভক্ত ২৪ পরগণা জেলার মজিলপুরের কানাইলাল ভট্টাচার্য । অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান । স্কুলে থাকতেই বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসে এবং যোগ দেয় বিভি বা Bengal volunteers-এ । দীনেশ গুপ্তর ফাঁসি হবার পর দলের নির্দেশে গার্লিক হত্যার দায়িত্ব নেয় । ইচ্ছে করেই পকেটে বিমলের নাম রেখেছিলেন, যাতে পুলিশ তাঁকে খোঁজা বন্ধ করে দেয় । বহুদিন পর্যন্ত পুলিশের ধারণা ছিল এই কিশোরই বিমল, এমনকি যখন পুলিশ কানাইয়ের মাকে ডেকে তার দেহ দেখায় , তিনিও তার ছেলে নয় বলে স্বীকারোক্তি দেন ।
সম্ভবত স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ইনি একমাত্র বিপ্লবী যিনি এক ইংরেজ শাসককে হত্যার কৃতিত্বের চেয়ে সহযোদ্ধার জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন ।
আজ যখন মানুষ আত্মপ্রচারের জন্য পাগল, নেতারা শৌচাগার উদ্বোধন করলেও টিভিতে মুখ দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তখন বড় বেশী করে মনে পড়ে কানাইদের কথা ।
দেশের স্বার্থে‚ বিপ্লবের জন্য নাম-যশ-খ্যাতি কোনও কিছুরই পরোয়া করতেন না কানাইলাল ভট্টাচার্যর মতো অগ্নিস্ফুলিঙ্গরা । তাঁর স্মৃতিতে আলিপুর বেকার রোডের নামকরণ করা হয়েছে বিপ্লবী কানাইলাল ভট্টাচার্য রোড । জন্মস্থান মজিলপুরের একটি রাস্তাও তাঁর নামে নামাঙ্কিত । পৈতৃক বাড়ির সামনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাঁর ব্রোঞ্জ মূর্তি । অবশ্য‚ দেশমাতৃকার মুক্তি ছাড়া এসব নিয়ে ভাববার সময় কোথায় ছিল কানাইলালদের ?
২৭শে জুলাই তাঁর প্রয়ান দিবস উপলক্ষে রইল রক্তিম শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
0 Comments