ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দিশা ও সাংবিধানিক কাঠামোর ওপর আঘাত হানছে বিজেপি
বিশ্বরূপ দে :: ২০২২-এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের যুদ্ধরেখা স্পষ্টভাবে টানা হয়ে গেছে । বিজেপি তার এনডিএ শরিকদের সমর্থন নিয়ে তাদের উড়িষ্যার প্রাক্তন বিধায়ক ও মন্ত্রী তথা ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন রাজ্যপাল দ্রৌপদি মুর্মুকে এনডিএ শিবিরের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে মাঠে নামিয়েছে । অন্যদিকে ভারতের বিরোধী দলগুলির অধিকাংশই প্রবীণ নেতা যশবন্ত সিনহাকে বিরোধী জোটের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেছে । বিরোধী পক্ষের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন এবং তাদের বিহার ও ঝাড়খণ্ডের বিধায়করা এই বিরোধী প্রার্থীকেই ভোট দেবেন বলে আশাবাদী লিবারেশন ।
এপ্রসঙ্গে সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে সম্প্রতি এক বিবৃতি জারি করা হয় । উক্ত বিবৃতিতে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বলেন,"যশবন্ত সিনহাকে বিরোধী প্রার্থী হিসেবে বেছে নেওয়া প্রগতিশীল মহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রভূত বিতর্ক ও আলোচনার জন্ম দিয়েছে । কারণ রাজনৈতিক জীবনের অধিকাংশ সময়টা তিনি বিজেপির সাথে যুক্ত ছিলেন । বাজপেয়ি সরকারে তিনি এক বরিষ্ঠ মন্ত্রী ছিলেন এবং মোদি জমানায় এসে বিজেপির অভ্যন্তরে বিরোধী কন্ঠ হয়ে উঠে শেষে ২০১৮ সালে পার্টি ছাড়েন । বিজেপিতে যোগ দেওয়ার আগে তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং বিজেপি ছাড়ার পর তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন । রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য টিএমসি থেকে পদত্যাগ করার আগে পর্যন্ত তিনি ছিলেন দলের জাতীয় সহসভাপতি । মোদি জমানার একনায়কতন্ত্রের সমালোচক হিসেবে তাঁর বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান ও ভূমিকার ওপর দাঁড়িয়েই তাঁকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী জোটের প্রার্থী মনোনীত করা হয়েছে"।
দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বলেন,"রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রশ্নে বিরোধী দলগুলির বোঝাপড়া অত্যন্ত বিলম্বে শুরু হয়েছিল । ১৫ই জুন প্রথম যে মিটিংটি হয় সেখানে সকলে মিলে একজন প্রার্থীকে দাঁড় করানোর সিদ্ধান্তে পৌঁছনো হয় এবং ২১শে জুনে সংগঠিত দ্বিতীয় মিটিংএ শ্রীযুক্ত যশবন্ত সিনহাকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয় । প্রগতিশীল মহল থেকে যে উদ্বেগগুলি ব্যক্ত করা হয়েছে, তা বিরোধী ঐক্য গড়ার পথে আরও ব্যাপক-বিস্তৃত বোঝাপড়ার প্রয়োজনীয়তাকে নির্দেশ করে । কেবলমাত্র রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে নয়, বরং আলোচনা দরকার চলমান গণ আন্দোলনগুলির মধ্যেও, যে আন্দোলনগুলি বাস্তবে মাঠে ময়দানে মূল বিরোধীপক্ষের ভূমিকা নিচ্ছে । এই ধরণের আলোচনা ও বোঝাপড়া বিকাশমান বিরোধী জোটকে আরও শক্তিশালী ও উন্নত করবে"।
কোবরা পোস্টের স্টিং অপারেশনের সূত্রে শ্রীযুক্ত সিনহার সাথে রণবীর সেনার যোগাযোগের অভিযোগ সম্পর্কেও কিছু বন্ধু উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন । একথা সকলেই জানেন যে সঙ্ঘ পরিবার রণবীর সেনাকে সম্পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা করতো এবং তখনকার দিল্লী ও পাটনার সরকার রণবীর সেনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় । বিহারের লড়াকু জনতার ধারাবাহিক আন্দোলন সাফল্যের সাথে রণবীর সেনার সেই পর্বকে মোকাবিলা করে এগিয়েছিল । আজ তাদেরকেই রণবীর সেনার থেকেও বৃহত্তর বিপদ বিজেপির বুলডোজার রাজের মোকাবিলা করতে হচ্ছে । এপ্রসঙ্গে লিবারেশনের শীর্ষ নেতৃত্ব বলেন,"আজকের এই সময়ে দাঁড়িয়ে কে কোন অবস্থান নিচ্ছে তার ভিত্তিতেই আমাদেরকে সহযোগী শক্তি বেছে নিতে হবে"।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বামপন্থীদের ভূমিকা প্রসঙ্গে পার্টির বক্তব্য, বামেদের জন্য মূল বিবেচ্য বিষয় হলো বিভিন্ন ধরণের বিরোধী দলগুলির কাছাকাছি আসা, যা এখন আরও সুব্যবস্থিত, দৃঢ় ও গতিশীল ধারায় এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে । ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে মতাদর্শগত স্পষ্টতা ও দৃঢ়তা এবং মাঠে ময়দানে ধারাবাহিক সংগ্রাম গড়ে তোলার মৌলিক ভূমিকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার সাথে সাথে, বিরোধী দলগুলির যতদূর সম্ভব ব্যাপক বিস্তৃত ও কার্যকরী ঐক্য গড়ে তোলা জরুরী যা বিজেপি/এনডিএ বিরোধী ভোট ভাগ হওয়া রুখবে । মোদি সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকরী বিরোধীপক্ষ গড়ে তোলার এই তাগিদ থেকে লিবারেশন ও অন্যান্য বাম দলগুলি যশবন্ত সিনহাকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হিসেবে গ্রহণ করেছে ও সর্বসম্মত বিরোধী প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরছে ।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে দুজন প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব কেন্দ্রীক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে দেখা ঠিক হবে না বলেই মনে করে লিবারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্ব । লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচনের মতো একে অবশ্যই ফ্যাসিস্ট শিবিরের বিরুদ্ধে এক রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত সংঘাত হিসেবেও বুঝতে হবে । বিজেপির বুলডোজার রাজ ও বেলাগাম কর্পোরেট লুট মোকাবিলার প্রেক্ষিতে অতীতের যে কোনও সময়ের তুলনায় বর্তমানে এক ঐক্যবদ্ধ বিরোধীপক্ষ খাড়া করার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি অনুভুত হচ্ছে । ঐক্যবদ্ধ বিরোধিতার পদক্ষেপকে সমর্থন করার সাথে সাথে সিপিআই (এমএল) লিবারেশন এই বিরোধী ঐক্যকে এক সাধারণ গণতান্ত্রিক এজেণ্ডা ও লাগাতার রাজনৈতিক অভিযানের দিশায় পরিচালিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাবে বলে বিবৃতিতে জানিয়েছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ।
পাশাপাশি, দল ও তার সমস্ত শুভানুধ্যায়ীদের কাছে আবেদন জানিয়ে নেতৃত্ব বলেন, "আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সংযুক্ত বিরোধীপক্ষের প্রার্থীর জয়ের জন্য প্রচার চালানো অত্যন্ত জরুরি । আমরা সমস্ত অ-বিজেপি দলগুলির কাছে আবেদন জানাচ্ছি বর্তমান সন্ধিক্ষণের গুরুত্ব অনুধাবন করে এক সাথে এসে মোদি সরকার ও সঙ্ঘ পরিবারের লাগাতার হামলার হাত থেকে ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের সংবিধান এবং যুক্তরাষ্ট্রীয়, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে রক্ষা করতে । আমরা আবেদন জানাচ্ছি দেশের জনগণের কাছে এবং সমস্ত চলমান গণ-আন্দোলনের কাছে, যাতে তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ বিধায়ক ও সাংসদদের এই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিতে বলেন"।
0 Comments