ব্রেকিং নিউজ

6/recent/ticker-posts

বেলুর মঠের বাঘানন্দ ও স্বামীজি

 নিজে হাতে রান্না করে বাঘাকে খাওয়াতেন স্বামীজি 

তথ্য ও গবেষণা

মহঃ এন্থনি বোস

        'বাঘা" নামে একটি দেশি সারমেয় (লোকে যাদের নেড়ি কুকুর বলে) বেলুর মঠে থাকতো । স্বামী বিবেকানন্দ খুব ভালোবাসতেন ওকে । স্বামীজীর ঘরের বাইরে পাপোশে ঘুমাতো বাঘা ।  মঠের ব্রহ্মচারী অভয়কে দিয়ে স্বামীজী প্রতিদিন বাজার থেকে দুধ, মাছের ছাঁট আনাতেন । নিজে হাতে রান্না করে খাওয়াতেন বাঘাকে । তবে স্বামীজির নির্দেশ ছিল, কেউ যেন ওকে মাংস না খাওয়ায় । কারণ মাংস খেলে ও হিংস্র হয়ে উঠতে পারে । স্বামীজী মঠ থেকে বাইরে গেলে বাঘা বিচলিত হয়ে উন্মাদের মত আচরণ করতো । যাকে দেখতো তেড়ে কামড়াতে আসতো । 

  একবার স্বামীজী মাস তিনেকের জন্য মঠে নেই । তখন বাঘার উৎপাত বেড়ে গেল । শেষে একদিন ঠাকুরের ভোগে মুখ দিয়ে ফেলায় মঠের সন্ন্যাসীরা তাকে নির্বাসন দিলেন । স্বামীজী কয়েকদিন পর মঠে ফিরে শুনলেন সবাই মিলে বাঘাকে বেঁধে নিয়ে গিয়ে গঙ্গার ওপারে দক্ষিণেশ্বরে ছেড়ে দিয়ে এসেছে । অথচ মঠ বাঘাকে ছাড়লেও বাঘা কিন্তু মঠকে ছাড়বার পাত্র মোটেই নয় । সে তক্কে তক্কে থাকে । সন্যাসীরা তাকে গঙ্গা পার করে দিয়ে ফিরে গেলে, বাঘাও কিছুদিন বাদে একটি ফিরতি নৌকায় উঠে বসলো । মাঝিরা তাকে নামাতে গেলে সে দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে আসে । অবশেষে নৌকার অন্য যাত্রীরা মাঝিদের বললো, ''কুকুরটা যখন কোনও ক্ষতি করছে না, চুপ করেই বসে আছে, তখন নিয়েই চলো ওকে।'' বাঘা এভাবে ফিরে এসে সারারাত বেলুড় মঠের আশেপাশেই লুকিয়ে রইল । স্বামীজি যথাসময়ে ফিরে এলেন । 

  বাঘা জানতো স্বামীজী ভোর হবার আগেই স্নানঘরে আসেন । বাঘা সেখানে লুকিয়ে স্বামীজীর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো । স্বামীজী এলে বাঘা তাঁর পায়ে মুখ ঘষতে ঘষতে কুঁই কুঁই করে কাঁদতে লাগলো । স্বামীজী বাঘাকে নিয়ে বেরিয়ে এসে মঠের সকলকে ডেকে বললেন, ''বাঘাকে আর এভাবে যেন কেউ কোনদিন তাড়িয়ে না দেয় । ও চিরদিন মঠেই থাকবে । সারমেয় হলো স্বয়ং ভৈরববাহিনী । ও যদি ঠাকুরের ভোগে মুখ দেয় তাতে দোষ কিসের ?"

তখন বাঘার আনন্দ দেখে কে ! লেজ নাড়তে নাড়তে গর্বের সঙ্গে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বাঘা ভৌ ভৌ করে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ করতে লাগল ।

  *সেদিন বাঘার মাথায় হাত বুলিয়ে স্বামীজী বলেছিলেন, "আমি না থাকলে তুই অমন পাগলামি করিস কেন ? আমি কি আর চিরকাল থাকব ?"*

  স্বামীজীর শিষ্য সদানন্দজী মহারাজ মস্করা করে একদিন বলছিলেন, "ওকেও দীক্ষা দিয়ে সাধু বানান মহারাজ । নাম দিন বাঘানন্দ।"

স্বামীজী বললেন, "ওরে স্বয়ং ধর্ম কুকুরের বেশে যুধিষ্ঠিরকে পথ দেখিয়েছিলেন । বাঘাও হয়তো সেরকমই কেউ । আমার কি সাধ্যি আছে ওকে দীক্ষা দেওয়ার ?"

  স্বামীজীর মৃত্যুর পর বাঘা তিনদিন কিছু খায়নি । করুণ মুখে স্বামীজীর ঘরের পাপোশটির উপর শুয়ে থাকতো । 

  বছর খানেক পর বাঘার মৃত্যু হয় । মঠের সন্যাসীরা সকালে স্বামীজীর ঘর পরিষ্কার করতে এসে দেখেন ঘরের চৌকাঠ আগলে বাঘা মরে পড়ে আছে । বাঘার মৃতদেহ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হল । ঠিক সেদিনই সন্ধ্যায় দেখা গেল ভাঁটার টানে বাঘার নশ্বর দেহটি আবার মঠভূমিতে ফিরে এসেছে । তখন বাঘার দেহ সসম্মানে মঠের জমিতেই সমাহিত করা হয় । স্বামীজীকে যেখানে দাহ করা হয় তার অনতিদূরেই বাঘার সমাধিবেদী ।

Post a Comment

0 Comments