পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কুৎসিত আস্ফালন "জামাইষষ্ঠী"
মহঃ এন্থনি বোস
বৈদিক শাস্ত্রে তাঁরা ব্রাত্য । কিন্তু তাঁদের স্থান সাধারণ মানুষের হৃদমাঝারে । বাংলার সেই লৌকিক দেবদেবীর অন্যতম হলেন মা ষষ্ঠী । প্রচলিত বিশ্বাস, তাঁর কৃপায় সন্তান আসে রমণীর কোলে । অন্য দিক দিয়ে দেখতে গেলে তিনি উর্বরতার দেবী । *কিন্তু তাঁর পুজোর সঙ্গেই জড়িয়ে গেল জামাই-আদরের পরম্পরা* ।
প্রসঙ্গত, সারা বছর আরও বেশ কিছু ষষ্ঠী তিথি পালিত হয় । কিন্তু সবথেকে জনপ্রিয় দুর্গা ষষ্ঠী এবং অরণ্য ষষ্ঠী বা জামাই ষষ্ঠী । জ্যৈষ্ঠ মাসে শুক্লা পক্ষের ষষ্ঠী তিথিকেই বেছে নেওয়া হয়েছে জামাই আপ্যায়নের জন্য । মধ্যযুগ হলো মঙ্গলকাব্যের রচনাকাল । সে সময় থেকেই বাংলায় এই রীতির প্রচলন বলে মনে করা হয় ।
শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের দিনগুলো যাতে মসৃণ হয়, সেই ভাবনা থেকেই জামাইবরণ । তবে পাশাপাশি শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে জামাইয়ের সম্পর্ককেও সুদৃঢ় করার ইচ্ছে লুকিয়ে আছে লৌকিকতার পিছনে । জামাইকেও নিজের সন্তান বলে পরিচয় দেওয়ার মাধ্যম এই লোকাচার । সেইসঙ্গে কন্যা যাতে নিঃসন্তান না হয়, সেই প্রার্থনাও থাকে মা ষষ্ঠীর কাছে ! *মিষ্টির হাঁড়ি হাতে ফিনফিনে সাদা মসলিনের পাঞ্জাবি আর মালকোচা মারা ধুতিতে শ্বশুরঘর আলো করা জামাই বাবাজি । পঞ্চব্যঞ্জনে সাজনো জামাইয়ের পাত । আম-কাঁঠাল, ইলিশের পেটি কিংবা কচি পাঠাঁর মাংস সহযোগে ভুরিভোজ । আর তার আগে জামাইকে পাখার হাওয়া আর শান্তি জলের ছিটা দেওয়া ! এমনকী মা ষষ্ঠীর আশীর্বাদ বলে জামাইয়ের হাতে হলুদ মাখানো সুতো পরিয়ে দেওয়া ! ‘জামাইষষ্ঠী’ মানে এই চিত্রই ভেসে ওঠে চোখের সামনে* ৷
তবে, মা ষষ্ঠীর সঙ্গে জামাইয়ের সম্পর্কটা কী ? এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক ৷ মনের মাঝে উঁকি দিতে পারে এ সম্পর্কে শাস্ত্র কী বলছে বা বিজ্ঞানটা কোথায় ?
ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে একসময় সংস্কার ছিল কন্যা যতদিন না পুত্রবতী হয় ততদিন কন্যার পিতা বা মাতা কন্যাগৃহে পদার্পণ করবেন না ৷ এই ব্যবস্থায় একটা সমস্যা দেখা দিল । সন্তানধারণে সমস্যা বা সন্তান মৃত্যুর (শিশুমৃত্যু) ফলে কন্যার পিতামাতাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হত কন্যার বাড়ি যাওয়ার জন্য ৷ সেক্ষেত্রে বিবাহিত কন্যার মুখদর্শন কীভাবে ঘটবে ? তাই সমাজের বিধানদাতাগন (ব্রাহ্মনগন) জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা ষষ্ঠীকে বেছে নিলেন জামাই ষষ্ঠী হিসাবে ৷ যেখানে মেয়ে জামাইকে নিমন্ত্রণ করে সমাদর করা হবে ও কন্যার মুখ দর্শন করা যাবে ৷ আর সেইসঙ্গে মা ষষ্ঠীর পুজো করে তাঁকে খুশি করা, যাতে কন্যা শীঘ্র পুত্রমুখ দর্শন করতে পারে ৷ বর্তমানে অবশ্য এই সংস্কার পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে । কন্যার পিতামাতা অথবা যে ব্যক্তি বিবাহের সময় কন্যা সম্প্রদান করবেন তিনি এক বৎসর কন্যার বাড়ি যাবেন না বা গেলেও কন্যার বাড়ির অন্নগ্রহণ করবেন না ৷
যদিও আধুনিক শহুরে জীবনে এই সংস্কার বিশেষ গুরুত্ব পায় না ৷ তা সংস্কার যাই হোক না কেন, মেয়ে জামাইকে ডেকে এনে সমাদর করা ও সেইসঙ্গে কন্যা যাতে সন্তানবতী হয় সেই লক্ষ্যে ‘মা ষষ্ঠীকে’ জুড়ে দিয়ে উৎসবের নামকরণই হল "জামাইষষ্ঠী"৷
ষষ্ঠী-পালন সাধারণত করে থাকেন মেয়েরা ৷ তবে তাঁদের কাছে এর তাৎপর্য অন্যরকম ৷ কথিত আছে — এক পরিবারে দুটি বউ ছিল ৷ ছোট বউ ছিল খুব লোভী ৷ বাড়ির মাছ বা অন্যান্য ভাল খাবার রান্না হলেই সে লুকিয়ে লুকিয়ে খেয়ে নিত, আর শাশুড়ির কাছে অভিযোগ করত ‘সব কালো বেড়ালে খেয়ে নিয়েছে ’৷ বেড়াল মা ষষ্ঠীর বাহন ৷ তাই বেড়াল, মা ষষ্ঠীর কাছে অভিযোগ জানালো ৷ মা ষষ্ঠী রেগে গেলেন ৷ যার জেরে ছোট বউ-এর একটি করে সন্তান হয় আর মা ষষ্ঠী তার প্রাণ হরণ করেন ৷ এইভাবে ছোট বউয়ের সাত পুত্র ও এক কন্যাকে মা ষষ্ঠী ফিরিয়ে নেন ৷ ফলে স্বামী, শাশুড়ি ও অন্যান্যরা মিলে তাকে "অলক্ষণা" বলে গালিগালাজ করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় ৷ অথচ বড় বউ পুত্রকন্যাদের নিয়ে সুখে ঘর করতে থাকে ৷ ছোট বউ মনের দুঃখে বনে চলে যান ও একাকী কাঁদতে থাকেন ৷ শেষে মা ষষ্ঠী বৃদ্ধার ছদ্মবেশে তার কাছে এসে কান্নার কারণ জানতে চান ৷ সে তার দুঃখের কথা বলে ৷ তখন মা ষষ্ঠী তার পূর্বের অন্যায় আচরণের কথা বললে সে মাফ চায় ৷ ষষ্ঠী তাকে ক্ষমা করেন | এরপর বলেন — ভক্তিভরে ষষ্ঠীর পুজো করলে সাতপুত্র ও এক কন্যার জীবন ফিরে পাবে ৷ তখন ছোট বউ সংসারে ফিরে এসে ঘটা করে মা ষষ্ঠীর পুজো করে ও ক্রমে ক্রমে তার পুত্র কন্যাদের ফিরে পায় ৷ এর থেকে দিকে দিকে ষষ্ঠী পুজোর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে ৷
(শুধু বিড়াল কেন, কোন পশু পাখিকেই মিথ্যা দোষারোপ করে তার ওপর অত্যাচার বন্ধ করা এবং তাদের প্রতি সহৃদয় হওয়ার পাঠ বা শিক্ষা হিসেবেই কেবল মা ষষ্ঠী নন, প্রত্যেক দেবদেবীর বাহন হিসেবেই প্রতিটা জীবজন্তুকে চিহ্নিত করা হয়েছে । বিড়াল, সারমেয় থেকে শুরু করে বাঘ, সিংহ সকলেই দেবদেবীর বাহন । তাদের সেবা করাই স্বয়ং ঈশ্বর সেবা)।
তবে মেয়ের মুখ দেখা বা শ্বশুরবাড়িতে তার ভালো থাকার জন্যই যদি "গান্ডেপিণ্ডে" গিলিয়ে জামাইকে সন্তুষ্ট রাখতে হয়, তবে "জামাইষষ্ঠী" নামক এই প্রথা বন্ধ হাওয়াই উচিত । কারণ এই প্রথা পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কুৎসিত আস্ফালন ।
0 Comments