ব্রেকিং নিউজ

6/recent/ticker-posts

আসানসোলের ঐতিহাসিক ঘাঘরবুড়ি চণ্ডীমায়ের মন্দির

গরিব পুরোহিতের কাতর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন ঘাঘরবুড়ি রুপী স্বয়ং মা চন্ডী 


তথ্য ও গবেষণা:

মহঃ এন্থনি বোস


         মায়ের সাধক বলতে সবসময় শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেব পরমহংস এবং বামাক্ষ্যাপার নামই সর্বাগ্রে । ত্যাগ, সংযম আর কঠিন জপ, তপ এবং শক্তি সাধনার মধ্যে দিয়ে সিদ্ধিলাভ করে সাক্ষাৎ দেবীদর্শন করেছিলেন তাঁরা । শুধু ভারতই নয়, পৃথিবীব্যাপী তাঁদের সাধনার কথা সর্বজন সমাদৃত । দেশী বিদেশী বহু শক্তিসাধক বা মাতৃসাধকের পথ প্রদর্শক শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস এবং বামদেব ।

  কিন্তু এমনও কিছু সিদ্ধপুরুষ রয়েছেন, যাদের কথা বা নামটাই মানুষের অজানা । অথচ, যজমানি বা সামান্য পৌরহিত্য করে কোনমতে সংসার চালানো এমনই একজন গরিব ব্রাহ্মণের কাতর ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর সামনে প্রকট হয়েছিলেন সাক্ষাৎ দেবী চন্ডী । স্বয়ং দেবীর আদেশেই সেই স্থানে চন্ডীমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়, যা আসানসোলের ঘাঘরবুড়ি চন্ডীমন্দির নামে খ্যাত । আর বাড়ি বাড়ি যজমানি করা সেই ব্রাহ্মণ ছিলেন কাঙালীচরণ চক্রবর্তী । 

  ঘাঘরবুড়ির চণ্ডীমন্দির যে শুধু অতি প্রাচীন তাই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক অলৌকিক উপাখ্যান এবং কিংবদন্তি ।

  আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগেকার কথা । বর্তমান আসানসোল মহানগর তখন ধূ ধূ করা মাঠ এবং আসান গাছের জঙ্গল ("আসান" হচ্ছে এক ধরণের বৃহৎ উদ্ভিদ, যার ছাল ফুটো করলে বের হতো প্রচুর সুমিষ্ট পানীয় জল, আর "সল" হচ্ছে রাঢ় বাংলার ডাঙ্গাল জমি বা ডাঙ্গাজমি । তবে দুঃখের বিষয়, এখন আর আসানসোলে আসানগাছ দেখা যায় না, যদিও তামিলনাড়ু ও দক্ষিণ ভারতে কিছুমাত্রায় পাওয়া যায়)।


  তখন জনমানবহীন প্রান্তরে কোথাও এক-আধটি বাড়ি, কোথাও আবার দু-তিনটি বাড়ি নিয়ে আসানসোল মহকুমার একেকটি ক্ষুদ্র গ্রাম । এই ছন্নছাড়া গ্রামগুলোতে যজমানি (পৌরহিত্য) করতেন এক গরীব ব্রাহ্মন, যার নাম ছিল কাঙালীচরণ চক্রবর্তী । প্রতিদিন তখনকার নুনিয়া নদী (আজকের শীর্ণকায় খাল সদৃশ) পেরিয়ে ওধারের গ্রামগুলিতে যেতেন পুজো অর্চনা করতে, আবার পদব্রজে নদী পেরিয়ে ফিরে আসতেন নিজ বাটিতে । এইভাবেই বহুকষ্টে দিন গুজরান করতেন তিনি । তবুও সংসার চলে না । 

  এক শীতের দিনে (দিনটি ছিল ১লা মাঘ) যজমানের ঘরে পুজো করে সেদিন কিছুই পাওয়া যায়নি । নুনিয়া নদী পেরিয়ে এসে ক্ষুধা তৃষ্ণায় ক্লান্ত কাঙালীচরণ এক গাছতলার শীতল ছায়ায় শুয়ে পড়লেন । অভাবের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে কাতর ভাবে ডাকতে লাগলেন মা চণ্ডীকে । কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন কাঙালীচরণ । হঠাৎ কীসের আওয়াজে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন । এই জনহীন প্রান্তরে কে যেন লাঠি ঠুক ঠুক করে আসছে ! বুঝতেই পারেননি যে কখন বিকেল পেরিয়ে গেছে । যখন জেগে ছিলেন তখন সূর্যদেব মাথার ওপরে ছিলেন, আর এখন প্রায় অস্তাচলে গিয়েছে ।

  কিন্তু বাঁশের লাঠির ঠুক ঠুক ছাড়া তো আর কোনো শব্দও শোনা যাচ্ছে না । নুনিয়া নদীর গর্জনও হঠাৎ থেমে গেল কী করে, আশ্চর্য !!

  একি !! দিনের আলো তো এখনও আছে, অথচ কিছুটা জায়গা একদম অন্ধকার কেন ? তবুও তো সেই অন্ধকারের মধ্যে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে – ঘাঘরা পরিহিত এক বুড়ি বাঁশের লাঠি ঠুক ঠুক করতে করতে ওনার দিকেই এগিয়ে আসছেন । সেই বুড়ি কিছু না বলে কাঙালীচরণের সামনে এসে দাঁড়ালেন । কাঙালীচরণের চোখ যেন ঝলসে গেল, সারা শরীর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ ঝলক বয়ে গেল । ঘুমের অতলে ডুবে গেলেন কাঙালীচরণ । ঘুমের মধ্যেই সেই বুড়িকে আবার দেখলেন । পরিষ্কার শুনতে পেলেন *তোর আর উঞ্ছবৃত্তির দরকার নেই, তোর কোলেই দেখবি তিনটি ছোট পাথরের ঢিবি রেখে এসেছি । মাঝখানে আমি – মা ঘাঘরবুড়ি, আমার বাঁয়ে মা অন্নপূর্ণা, ডাইনে পঞ্চানন মহাদেব । এইখানেই মন্দির প্রতিষ্ঠা কর, আর কোথাও যেতে হবে না*।

  মা ঘাঘরবুড়ির আদেশে ওই স্থানে মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় ১৬২০ সালে । ওই পাথরের ঢিবিগুলিকেই ফুল এবং রুপোর গয়নায় সাজানো হয় । আর সেই বিশেষ দিন অর্থাৎ ১৬২০ সালের ১লা মাঘকে স্মরণ করে প্রতি বছর মন্দিরের সামনের মাঠে বসে ঘাঘরবুড়ি চণ্ডীমাতার মেলা ।


আসানসোল মহকুমা যেমন কয়লা ও ইস্পাত শিল্পের জন্য বিখ্যাত, তেমনই বিভিন্ন জাগ্রত দেব-দেবীর আর্শীবাদপুষ্ট ও মহিমামন্ডিত । আসানসোল শহরের উত্তরে ক্লেদবাহী শীর্ণকায় নুনীয়া নদীর তীরে অধিষ্টিতা রাঢ় বাংলার জাগ্রত দেবী মা শ্রীশ্রী ঘাঘরবুড়ি ।

  কিন্তু কে এই ঘাঘর বুড়ি ? কিভাবে এখানে প্রতিষ্ঠিতা হলেন ? 

ইতিহাস বলছে কাশিপুর মহারাজার রাজ্য সীমানা ছিল আসানসোল পর্য়ন্ত ।

প্রমান্য তথ্য থেকে জানা যায়, বহু প্রাচীন কাল থেকে অনাচ্ছাদিত মন্দিরে, গাছ তলায় পুজিতা হয়ে আসছেন মা ঘাগরবুড়ি । (বর্তমানে নির্মিত হয়েছে মনোরম মন্দির)। ইনি দেবী শ্রীশ্রী চন্ডী । তবে দেবীর কোন মূর্তি নেই । শুধু তিনটি শীলা । ঘাঘর শব্দের অর্থ হল – ঝাঁজবাদ্য ও ঘুঙুর । পুরাণে দেব-দেবীর বিভিন্ন পুজা পদ্ধতির উল্লেখ আছে- তার মধ্যে নৃত্য গীত-বাদ্য সহকারে বহু দেবীর পূজার প্রচলন ছিল । মায়ের মন্দির সংলগ্ন এলাকাটি আদিবাসী অধ্যুষিত । অতীতে যে মায়ের পূজা নৃত্য-গীত-বাদ্য সহকারে হতো সেবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । 

  ঘাঘর শব্দের আরেকটি অর্থ হল নদী । নুনীয়া নদীর দক্ষিণ তীরে মায়ের মন্দির । এমনও হতে পারে যে এই জন্যই দেবী চন্ডীর এখানে নামকরণ হয়েছিল *ঘাঘরবুড়ি*।

Post a Comment

0 Comments