তথ্য ও গবেষনা:
মহঃ এন্থনি বোস
২রা শ্রাবন মা তারার সাধক সন্তান বামাক্ষ্যাপার (Bamakhepa) তিরোধান দিবস । বীরভূম জেলার এই কালী সাধক মা তারাকে বড়মা বলে ডাকতেন । শ্মশান ছিল তাঁর সাধনক্ষেত্র । বাংলার ১৩১৮ সনের ২রা শ্রাবন রাত্রি ১টা বেজে ৫মিনিট নাগাদ ধ্যানমগ্ন অবস্থায় সাধক বামাক্ষ্যাপার ব্রহ্মতালু হঠাৎই ফেটে যায় এবং সেখান থেকে রক্তপাত হতে থাকে । নিমেষেই তন্ত্রসিদ্ধ ত্রিকালদর্শী মাতৃসাধক বামাক্ষ্যাপা মনুষ্য শরীর ত্যাগ করে সূক্ষ্ম শরীরে শিবলোকে পৌঁছে যান ।
বামদেব ছিলেন উনিশ শতকের অপার প্রসিদ্ধ কালীভক্ত শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবের সমসাময়িক । অল্প বয়সেই তাঁর গৃহত্যাগ এবং তন্ত্র শিক্ষালাভ হয় । তিনি ছিলেন মা কালীর আরেক রূপ তারা মায়ের একনিষ্ঠ ভক্ত । তারাপীঠের নিকটবর্তী মল্ল রাজাদের মন্দিরময় গ্রাম মালুটিতেই ছিল তাঁর সাধনক্ষেত্র । দেবতা ও মানুষ, মানুষ ও পশু, জাত ও বেজাত এবং ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে কোনদিন কোনরকম ভেদাভেদ করেননি বামদেব । বাকসিদ্ধ মাতৃসাধক ছিলেন তিনি, তাই মুখে যা বলতেন, সেটাই ঘটে যেত ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার স্বচক্ষে এই সিদ্ধপুরুষকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন । সেইমতো চারণকবি মুকুন্দ দাসের সঙ্গে তারাপীঠ গিয়ে বামদেবের সাথে দেখা করার জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন । দিন পেরিয়ে সন্ধ্যায় যুবক রবি ঠাকুরের সাথে দেখা হয় বামাক্ষ্যাপার । তিনি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছু না জেনেই বলেছিলেন,"বিশ্বজুড়ে তোর খুব নামডাক হবে"।
রামকৃষ্ণদেবের সংস্পর্শে আসার পর নরেন্দ্রনাথেরও (স্বামী বিবেকানন্দ) একবার বামদেবকে দেখার ইচ্ছে হয় । তখন নরেন্দ্রনাথের বয়স মাত্র ১৯ বছর । কলেজের এক সহপাঠী শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীকে নিয়ে পৌঁছে গেলেন বীরভূমের তারাপীঠে । দেখা হওয়া মাত্রই বামাক্ষ্যাপা এবং নরেন্দ্রনাথ দুজনে দুজনের দিকে দীর্ঘক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইলেন । সেই মহা সন্ধিক্ষনে দুজনেই অপার আনন্দে আপ্লুত হয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েছিলেন ।
ঠিক কি ঘটেছিল সেইদিন, অর্থাৎ ১৩১৮ সনের ২রা শ্রাবন ?
সাধক বামাক্ষ্যাপার তখন বয়স হয়েছে প্রায় ৭৪ বছর । শরীরের মাংস পিণ্ড ঝুলে গিয়েছে । বসে থাকলে উঠতে অসুবিধা হয় । শিষ্য নগেন বাগচি ধরে ধরে বসিয়ে দিতেন, উঠিয়ে দিতেন । হঠাৎ একদিন ক্ষ্যাপাবাবা রাত্রিবেলাতে নগেনকে বললেন "ডাক এসেছে লগেন, ডাক এসেছে, ওরা আমাকে ডাকছে"। নগেন ক্ষ্যাপাবাবাকে বললেন,"কি সব উল্টো পাল্টা বকছো বাবা । চুপ করো তো ! তুমি শুয়ে পড় । এখন গভীর রাত। মায়ের মঙ্গল আরতির এখন অনেক দেরি"। এই বলে ক্ষ্যাপা বাবাকে শুইয়ে দিলেন এবং পাশের বিছানায় নগেন শুয়ে পড়লেন । কিন্তু নগেনের আর ঘুম আসে না । কেননা নগেন বুঝতে পারলেন ক্ষ্যাপা বাবা আর এ জগতে থাকবেন না ।
রাত্রি পেরিয়ে ঊষাকাল হলো । হঠাৎ ক্ষ্যাপাবাবা ওই ভোর বেলায় নগেনকে বললেন, "লগেন আমাকে নদীর ঘাটে নিয়ে চল্ — আমি চান করব"। নগেন বললেন "ক্ষ্যাপাবাবা তোমার শরীর ভাল নাই, এত ভোরে তুমি দ্বারকা নদীর জলে চান করবে ! "হ্যাঁ করব শালা ! তাতে তোর কি রে শালা ?" নাদসিদ্ধ ক্ষ্যাপার হুঙ্কারে যেন মহাশ্মশান কেঁপে উঠলো । নগেন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ক্ষ্যাপা বাবাকে দ্বারকা নদীর ঘাটে নিয়ে গেলেন ।
ত্রিকালদর্শী নাদসিদ্ধ তন্ত্রসাধক বীরাচারী বামাচারী ক্ষ্যাপাবাবাকে নগেন নদীতে নিয়ে গেলেন । ক্ষ্যাপাবাবা নদীতে খুব করে ডুব দিতে লাগলেন । যতবার ডুবলেন ততবার তারা মায়ের নাম ধরে "জয় জয় তারা" "জয় জয় তারা" বলে চিৎকার করতে থাকেন । চান করে ক্ষ্যাপা বাবা নদীর ঘাটে বসে থেকে অনেক পরে উঠলেন । নগেন বামাক্ষ্যাপাকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষ্যাপা ঝোপড়ায় নিয়ে গেলেন । ক্ষ্যাপাবাবা ঝোপড়া থেকে বেড়িয়ে শিমূলতলায় গেলেন । সেখানে মায়ের ব্রহ্মশিলার চরণে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে অনেক কান্নাকাটি করে মায়ের সঙ্গে অনেক লীলা করলেন । এদিকে মন্দিরে মঙ্গল আরতির ঘন্টা-কাঁসরের আওয়াজ আসলো । মা তারা মা তারা — জয় জয় তারা — জয় জয় তারা নামে ক্ষ্যাপাবাবা তাঁর নিনাদে মহাশ্মশান কাঁপাতে শুরু করলেন । তখন কে বলবে যে ক্ষ্যাপাবাবার বয়স হয়েছে !
মঙ্গল আরতির ঘন্টা শেষ হলো । ক্ষ্যাপাবাবা নগেনকে ডেকে বললেন, "লগেন এই দ্যাখ শালা এইখানে আমার সমাধি দিবি । আমার বড়মার সঙ্গে এইমাত্র সেই কথাই হলো"। এই বলে ক্ষ্যাপাবাবা নগেনকে বললেন, "তোল শালা তোল"। নগেন ক্ষ্যাপাবাবাকে দুই বাহুতে ধরে তুলে দাঁড় করালেন । ক্ষ্যাপাবাবা ও নগেন 'ক্ষ্যাপা-ঝোপড়া' চলে গেলেন । তারপর ক্ষ্যাপাবাবা নগেনকে বললেন, "শালা গাঁজা সাজ"। আরেক শিষ্য নন্দা ততক্ষণে ক্ষ্যাপা-ঝোপড়াতে এসে গিয়েছেন । নন্দা সারাদিন ক্ষ্যাপা-ঝোপড়াতে কাটিয়ে রাত্রিতে বেশীর ভাগ দিন নদীর ওপারে বাড়িতে চলে যেতেন । গাঁজা সাজতে সাজতে নগেন নন্দাকে সব কথা খুলে বললেন । নন্দা সব শুনে হাও মাও করে কাঁদতে লাগলেন । ক্ষ্যাপাবাবা নন্দার কাঁদার শব্দ শুনতে পেয়েছেন । "লগনা, ও শালা লগনা, লন্দা শালা কাঁদছে ক্যানেরে ?" - "ও কিছু নয় বাবা" - এই বলে নগেন ক্ষ্যাপাবাবাকে বাক্ মানালেন ।
এইভাবে সারাদিন গেল । দুপুরে সামান্য মায়ের ভোগ খেয়ে ছিলেন ক্ষ্যাপাবাবা । সন্ধ্যাবেলায় মায়ের আরতি হয়ে গেল । আরতির প্রসাদ লুচি, চিড়ে, মুড়কি ক্ষ্যাপা খুব সামান্য খেয়ে নগেন ও নন্দাকে খেতে বললেন । তারা প্রসাদ খেলেন । তারপর ক্ষ্যাপাবাবা তন্ত্রের ক্রিয়া শুরু করলেন । মাঝে গাঁজা সেবনও করলেন । তন্ত্রক্রিয়া করার পর উত্তর দিকে মুখ করে ওই যে জয় জয় তারা — জয় জয় তারা রব ধরলেন, ওই নাম ধরেই রইলেন ।
গভীর রাত্রে আনুমানিক ১-০৫ মিনিট নাগাদ ক্ষ্যাপা বাবার ব্রহ্মতালু হঠাৎ করেই ফট্ করে ফেটে গেল । ব্রহ্মতালু বেয়ে সামান্য রক্ত গা বেয়ে ভূমিতে পড়লো । নিমেষেই বামাক্ষ্যাপার "জয় তারা, জয় তারা" নাদ বন্ধ হয়ে গেল ।
মাতৃ সাধক শ্রীশ্রী বামদেব বাংলা ১৩১৮ সনের ২রা শ্রাবণ আষাঢ়ে কৃষ্ণাষ্টমী তিথিতে রাত্রি আনুমানিক ১-০৫ মিনিট নাগাদ ইহলোক ত্যাগ করে শিব লোকে অর্থাৎ মনুষ্য কায়া ত্যাগ করে সুক্ষ্ম শরীরে বিরাজমান হলেন ।
0 Comments